২০২১ সালের আগস্টে তালেবান যখন কাবুলের ক্ষমতা দখল করে তখন পাকিস্তানের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমদ আফগানিস্তানের সঙ্গে তোরখাম সীমান্তে একটি বিজয়সূচক সংবাদ সম্মেলন করেন।
সেই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তালেবানের দ্রুত ক্ষমতা দখল ‘একটি নতুন জোট’ তৈরি করবে এবং এই অঞ্চল বৈশ্বিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সেই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনকে ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙার’ সাথে তুলনা করেন।
প্রায় ২০ বছর ধরে আফগান তালেবান একটি সুসংগঠিত ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্রোহ চালিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ৪০টিরও বেশি দেশের একটি বিশাল সামরিক জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সেই সময় তালেবান নেতা ও যোদ্ধারা পাকিস্তানে, বিশেষত আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে আশ্রয় পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: আফগান সীমান্তে সংঘর্ষে ১৯ পাক সেনা নিহত
এমনকি তালেবান নেতারা দেশটির কোয়েটা, পেশোয়ার ও পরবর্তীতে করাচির মতো প্রধান শহরগুলোতেও অবস্থান করেছেন। সংগঠনটির অনেক নেতা ও যোদ্ধা দারুল উলুম হাক্কানিয়ার মতো পাকিস্তানের বহু মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন। যেখানে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমর পড়াশোনা করেছেন বলে জানা যায়।
এক কথায় পাকিস্তানে তালেবান এমন একটি পরিবেশ পায় যা তাদেরকে পাকিস্তানের সমাজের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। যা তাদেরকে নতুন করে সংগঠিত হতে এবং ২০০৩ সালের দিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সামরিক বিদ্রোহ শুরু করতে সক্ষম করে তোলে। পাকিস্তানের সমর্থন ও আশ্রয় ছাড়া এই বিদ্রোহ সফল করার অসম্ভব হতো।
এত কিছুর পরও সম্প্রতি ইসলামাবাদ ও আফগান তালেবানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে। যার সবশেষ দৃষ্টান্ত আফগানিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিমান হামলা।
গত সপ্তাহে (২৪ ডিসেম্বর) হঠাতই প্রতিবেশী দেশের ভেতরে দুই দফায় বিমান হামলা চালায় পাক বাহিনী। ভয়াবহ ওই হামলায় নারী ও শিশুসহ অন্তত ৫১ আফগান নিহত হয়। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) সেই হামলার জবাবও দিয়েছে আফগান তালেবান। তাতে অন্তত ১৯ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে।
কিন্তু দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যকার সম্পর্ক এমন আদায়-কাঁচকলায় রূপ নিল কেন?
ঐতিহাসিক ও বর্তমান কারণ
পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই জটিল। পাকিস্তান কাবুলে তালেবানকে স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে স্বাগত জানায়। পাকিস্তানের প্রত্যাশা ছিল, বিভিন্ন ইস্যুতে তালেবান সহযোগী ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তালেবান সরকার সেই প্রত্যাশার তুলনায় কম সহযোগী প্রমাণিত হচ্ছে।
তালেবান আফগান সমাজের বিস্তৃত সমর্থন অর্জনে জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিয়েছে। তালেবান নেতারা একটি যোদ্ধা গোষ্ঠী থেকে একটি সরকারে রূপান্তরিত হতে আগ্রহী, যা একটি চলমান প্রচেষ্টা। তারা পাকিস্তানের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার বাইরে গিয়ে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে ঔপনিবেশিক আমলের সীমানারেখা ডুরান্ড লাইন। এই রেখা দেশ দুটিকে বিভক্ত করেছে। তবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো আফগান সরকারই এই রেখাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত দেয়নি।
আরও পড়ুন: কাজাখস্তানে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে কি রাশিয়ার ‘হস্তক্ষেপ’ দায়ী?
যদিও ডুরান্ড লাইন আন্তর্জাতিকভাবে দুই দেশের সীমানা হিসেবে স্বীকৃত এবং পাকিস্তান প্রায় পুরোটাই বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। তবে আফগানিস্তানে এই লাইন একটা আবেগের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। কারণ এই রেখা পশতুন জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করেছে।
১৯৯০-এর দশকের তালেবান সরকার ডুরান্ড লাইনকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং বর্তমান তালেবান সরকারও তাদের পূর্বসূরিদেরই অনুসরণ করছে। পাকিস্তানে বিষয়টিকে একটি বিশৃঙ্খলা হিসেবে দেখা হয়। একই সঙ্গে পাকিস্তানের ‘কৌশলগত অবস্থান’র জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি
আফগানিস্তানে তালেবানের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তৎপরতা পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়েছে বলে মনে হয়। ২০২২ সাল থেকে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে নিয়মিত হামলার ঘটনা ঘটছে।
আর এসব হামলার বেশিরভাগেরই দায় স্বীকার করেছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) বা তথাকথিত পাকিস্তানি তালেবান। টিটিপি ও আফগান তালেবান দীর্ঘদিন ধরে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। একে অপরের সঙ্গে আশ্রয়, কৌশল ও সম্পদ ভাগাভাগি করেছে। বিশেষ করে ওয়াজিরিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অন্যান্য পাকিস্তানি অঞ্চলে এটা দেখা গেছে।
পাকিস্তান ২০০১ সালের পর আফগান তালেবানকে 'বন্ধু' হিসাবে আচরণ করেছে। উদ্দেশ্য ছিল, আন্তঃসীমান্ত পশতুন জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দুর্বল করা এবং তালেবানের ওপর পশতুনদের যে প্রভাব তাকে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে কাজে লাগানো।
আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ায় ভয়াবহ দাবানল, সিঙ্গাপুরের আয়তনের সমান এলাকা পুড়ে ছাই
২০১১ সালে তৎকালীন মার্কিন সেনাপ্রধান মাইকেল মুলেন এই সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, আফগান তালেবানের একটা বড় শক্তি হাক্কানি নেটওয়ার্ক পাকিস্তানের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (আইএসআই) একটি ‘অবিচ্ছেদ্য হাত’ হিসেবে কাজ করছে।
বিশ্লেষকরা সেই সময় সতর্ক করে বলেছিছেন, আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের জন্য পাকিস্তানের সমর্থন এমন একটি ‘বিজয়’-এর দিকে নিয়ে যাবে যার ফলে পাকিস্তানি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দুর্বল হওয়ার চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তালেবানের প্রত্যাবর্তনের পর কার্যত বিশ্লেষকদের সেই কথাই সত্যি হয়েছে।
উত্তেজনার গুরুত্ব ও প্রভাব
পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় টিটিপি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে পাকিস্তান। তবে তালেবান পাকিস্তানের এই মানবে তেমন সম্ভাবনা কম। উল্টো এমন পদক্ষেপ তালেবান ও টিটিপির ভারসাম্য নষ্ট করবে এবং ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রোভিন্স-এর (আইএসকেপি) মতো অন্যান্য চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ তৈরি করবে।
তালেবান নেতারা এখন সেই যুক্তিই দিচ্ছেন যা পাকিস্তান গত দুই দশক ধরে ব্যবহার করেছে। সাবেক আফগান সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র ইসলামাবাদকে বারবার পাকিস্তানের ভেতরে তালেবানের তৎপরতা রোধ করার দাবি জানায়। কিন্তু ইসলামাবাদ বরাবরই সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানের মতোই আফগান তালেবান এখন যুক্তি দিচ্ছে, টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং এই সমস্যা ইসলামাবাদকেই সমাধান করতে হবে। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্ভবত আফগান ভূখণ্ডে দায়মুক্তভাবে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাবে।
এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের খুব একটা সমালোচনার মুখে পড়তে হবে না। দুর্ভাগ্যবশত আন্তর্জাতিকভাবে এমন নজির ক্রমবর্ধমানভাবেই বাড়ছে। ইসরাইলের মতো দেশগুলো নিরাপত্তা হুমকির অজুহাত তুলে সীমান্ত পেরিয়ে ভিন্ন দেশে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে।
আরও পড়ুন: দক্ষিণ কোরিয়া / প্রেসিডেন্টের পর এবার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টও অভিশংসিত
এছাড়া দেশের নিরাপত্তার অভিভাবক হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সন্ত্রাসবাদ দমন ও দেশের অবকাঠামো, বিশেষত বেলুচিস্তানে চীনের বিনিয়োগকৃত প্রকল্পগুলো রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে বেশ চাপের মুখে রয়েছে।
এদিকে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের সম্পদের অভাব। নেই একটা সংগঠিত সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব যা দিয়ে পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
এরপরও তালেবান নেতারা বলছেন, পাকিস্তানের হামলার ‘প্রতিশোধ’ নেয়া হবে। তবে পাকিস্তানের মতো সামরিকভাবে শক্তিশালী একটি প্রতিবেশী এবং দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত মিত্র দেশের বিরুদ্ধে তারা সেটা করবে সেটা স্পষ্ট নয়।
পাকিস্তানের হাতে তালেবানদের ওপর প্রভাব বজায় রাখার অন্য উপায়ও রয়েছে। আফগানিস্তানে যেকোনো বাণিজ্য পাকিস্তানের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। পাকিস্তান কয়েক দশক ধরে লাখ লাখ আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
আরও পড়ুন: আফগানিস্তানে পাকিস্তানের বিমান হামলায় নিহত ৪৬
তবে আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক কার্যক্রম আফগান জনগণের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব উসকে দেবে। পাকিস্তানি পশতুনদের আরও দূরে সরিয়ে দেবে। আফগান পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে বিদ্রোহ সমাজের ক্ষোভ, বঞ্চনা ও যুব সমাজের হতাশার ওপর নির্ভর করে।
সমাধানে প্রয়োজন সাহসী পদক্ষেপ
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার ইস্যগুলো সমাধান করার জন্য দুই দেশের নেতাদের দীর্ঘমেয়াদি সাহস দেখাতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি প্রদর্শন হয়তো সাময়িকভাবে সংবাদে শিরোনাম হতে পারে। তবে শান্তি অর্জন বুদ্ধিমত্তাও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়।
মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক হাব উয়ে ওঠার দেশ দুটির বিপুল সম্ভবনা রয়েছে। তবে দুঃখজনকভাবে নেতৃত্ব, রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার অভাবে গত এক প্রজন্ম ধরে দুই দেশের ৩০ কোটি মানুষের সমৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
]]>