অবশ্য পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে প্লান অনুমোদনসহ আনুষাঙ্গিক কাজ করছে তারা। আর ফায়ার সার্ভিসের দাবি, ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত কাজ করছে তারা। পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টাও করছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন যশোরের পাঁচ তারকাবিশিষ্ট ১৬ তলা অভিজাত হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে আগুনের ঘটনায় ২৪ জনের প্রাণহানিতে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। জেলা শহরের বহুতল ভবনগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর সক্ষমতার প্রশ্নটি আবারও চলে আসে সামনে। জাবিরের আগুন নেভানোর জন্য ৬৪ কিলোমিটার দূরের বিভাগীয় শহর খুলনা থেকে আনতে হয় টার্ন টেবল লেডার বা টিটিএল।
যশোর প্রাচীন শহর হলেও এখনও বিকাশমান। দ্রুত গতিতে শহর সম্প্রসারণ হচ্ছে। বাড়ছে বহুতল ভবনের সংখ্যা। বিশেষ করে গত ২০ বছরে যশোর শহরেই শতাধিক সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়েছে। অনুমোদনের সময় ফায়ার প্লান নেয়া হলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে এসব ভবনের অধিকাংশই রয়েছে চরম অগ্নিনির্বাপক ঝুঁকিতে। সেই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছে ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম, উদ্ধার গাড়ি ও শক্তিশালী পাম্পের অপর্যাপ্ততা ও পুকুর-জলাশয় ভরাট হওয়ায় পানির উৎস না থাকার বিষয়টি। যা নিয়ে চিন্তিত বহুতল ভবনের বাসিন্দারা। তারা চান ফের কোন দুর্ঘটনা ঘটার আগেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক ফায়ার সার্ভিস।
আরও পড়ুন: সিদ্ধিরগঞ্জে ফার্নিচার মার্কেটে আগুন, ১৪ দোকান পুড়ে ছাই
শহরের একসেনসিউর পূর্বাচল টাওয়ারের বাসিন্দা ফজলে রাব্বি মোপাশা বলেন, আমাদের দশতলা বিশিষ্ট ভবনে ২০টি পরিবারে শতাধিক মানুষ বসবাস করে। কিন্তু এত বড় ভবনে আমাদের নিজস্ব কিছু নির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বড় ধরনের আগুন লাগলে সেটা নিয়ন্ত্রণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের যে সক্ষমতা থাকা উচিত সেটা যশোর ফায়ার সার্ভিসের নেই। তাদের রেসকিউ (উদ্ধার) সক্ষমতা আছে ৫ থেকে ৬ তলার পর্যন্ত। আমাদের ভবনটি দশতলা এখানে তাদের উদ্ধার সক্ষমতা নেই বললেই চলে। ফলে সেই ব্যবস্থাপনা না হওয়া পর্যন্ত আমরা তো চরম ঝুঁকির মধ্যেই আছি।
শহরবাসী তসলীম উর রহমান বলেন, এই শহরে আধুনিকতার কারণে প্রতিনিয়ত বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। বহুতল ভবনের ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অগ্নিকাণ্ড। অগ্নি নির্বাপণের বিষয়টি বরাবরই ভবন মালিকরা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া বহুতল ভবনের অগ্নি নির্বাপণের জন্য যে সরঞ্জাম দরকার তা ফায়ার ব্রিগেডেরও নেই। এদিকে শহরে দিন দিন কমছে পুকুরের সংখ্যা। ইতিমধ্যে পানির অপ্রতুলতা প্রত্যক্ষ করেছে ফায়ার ব্রিগেড। এ অবস্থায় বড় কোন অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ও প্রাণহানির চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে যশোর।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি কিছুদিন আগে যশোর জাবের ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে অগ্নিকাণ্ড কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তা নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয় ফায়ার সার্ভিস। ফলে ২৪টি প্রাণ হারাতে হয়েছে আমাদের। আমরা চাই নতুন ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হোক এবং ফায়ার সার্ভিসকে আরও আধুনিক উন্নত যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ করা হোক।
জিল্লুর রহমান ভিটু নামে এক রাজনীতিবিদ বলেন, বলা যায় আমরা আগ্নেয়গিরির উপরে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের শহরে আগুন নেভানোর কোন সুপরিকল্পিত আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। বহুতল ভবনগুলো নির্মাণে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা মানা হয় না। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই শহরে বস্তিগুলোয় আগুন লাগলে তা নেভানো সম্ভব হয় না। সেখানে বহুতল ভবনে আগুন লাগলে কি অবস্থা হবে ভাবনাই আনতে পারি না। খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আমরা আছি। এখনই যদি সতর্ক না হওয়া যায় তাহলে যশোর শহরেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে করুণ পরিণতি হতে পারে।
যশোরের নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিঠু বলেন, আমি বলব ঝুঁকি না, আসলে আমরা অগ্নি চেম্বারের উপরে বসবাস করছি। যশোর ফায়ার সার্ভিস মান্দাত্তা আমলের একটি পানি টানা লেডার ও মোটর পাম্প দিয়ে বৃহত্তর যশোরের অগ্নি নির্বাপণের চেষ্টা করছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসে যে ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি রাখা দরকার ছিল সেটা হয়নি।
আরও পড়ুন: নারায়ণগঞ্জে মার্কেটে ভয়াবহ আগুন, ১৯ দোকান পুড়ে ছাই
তিনি আরও বলেন, যশোরের শতাধিক বহুতল ভবন রয়েছে। আরও কিছু নির্মাণাধীন। এ ধরনের ভবনে আগুন লাগলে যশোরের ফায়ার সার্ভিস যে কত খানিক ব্যর্থ হয় তা আমরা দেখেছি জাবের ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের অগ্নিকাণ্ডে। এই ভবনে আগুন লাগার সময় ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ঘটনাস্থলে গেলেও শুধুমাত্র আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়। যার জন্য ২৪টি তাজা প্রাণ আমরা হারিয়েছি। যশোরবাসীকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ করতে ফায়ার সার্ভিসে ফোম গাড়ি, ন্যূনতম দশতলা পর্যন্ত আগুন নেভাতে সক্ষম লেডার সিস্টেম গাড়ি সংযুক্ত করা দরকার। তা না হলে যশোরবাসীকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ করা সম্ভব হবে না।
যশোর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শরীফ হাসানের দাবি ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, একতলা হোক বা ১০ তলা হোক প্রত্যেকটি বাড়িতেই গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে। ফলে সেখানে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থাকবেই। এজন্য ভবন নির্মাণের প্লান অনুমোদনের সময় ফায়ার সার্ভিস কোডের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কিন্তু এটা মনিটরিং এর দায়িত্ব বা এক্সপার্ট ফায়ার সার্ভিসের। তারা যখনই এ বিষয়ে সহযোগিতা চাইবে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
তিনি আরও বলেন, অগ্নি নির্বাপণে পুকুরের পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শহরের অধিকাংশ পুকুরই বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য আমরা এখন কোন পুকুর বন্ধ (জমির শ্রেণি পরিবর্তন) করে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেই না। এভাবে আমরা শহরের অবশিষ্ট পুকুরগুলো বাঁচানোর চেষ্টা করছি। তারপরও কেউ গোপনে পুকুর বন্ধের চেষ্টা করলে আমরা পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
এদিকে যশোর ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, বহুতল ভবন মালিকদের নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য পরামর্শ পত্র দেয়া হচ্ছে।পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম, উদ্ধার গাড়ি ও পাম্পের চাহিদাপত্র দিয়েছি। আমরা আশা করি যে চাহিদা মাফিক জিনিসগুলো পাবো। সেগুলো হাতে পেলে বহুতল ভবনে অগ্নি নির্বাপণ আমরা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবো।
প্রসঙ্গত, কেবল বহুতল ভবন নয় অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে বেনাপোল স্থলবন্দর, যশোর বিমানবন্দরসহ রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ১২টি কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন বা কেপিআই স্থাপনা। এর মধ্যে ১০টিকে রক্ষায় করণীয় বিষয়ে সুপারিশমালা ঊর্ধ্বতন মহলে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।