দেশমাতৃকা রক্ষায় বাংলার অকুতোভয় সেনা দল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার লড়াইয়ে ছিলেন সামনের সারিতে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অম্লান বীরত্বগাঁথা। এ যেন এক অজানা অধ্যায়। ৭১ এ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে তখনই পূর্ব বাংলার সেনানিবাসগুলোতে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালি সেনারা। এতে নেতৃত্ব দেয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। পরে তাদের নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। এতে যোগ দেয় মুক্তিকামী সাধারণ জনতা। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বাঙালি সৈনিকদের সেই বীরত্ব গাঁথা কথা উঠে এসেছে সময় সংবাদের প্রতিবেদনে।
একাত্তরের উত্তাল মার্চ, যখন আকাশে বাতাসে প্রকম্পিত হচ্ছে স্বাধীনতাকামী মানুষের স্লোগান; ঠিক তখন দেশমাতৃকাকে রক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিপ্লবী বাঙালি সেনারা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত একমাত্র রেজিমেন্ট ছিল ইস্ট বেঙ্গল। যার পাঁচটি ব্যাটালিয়ন ছড়িয়ে ছিল পূর্ব বাংলার জয়দেবপুর, যশোর, কুমিল্লা, সৈয়দপুর আর চট্টগ্রামে। আর বাকি তিনটি ছিল পাকিস্তানের লাহোর ও করাচিতে।
একাত্তরের মার্চের ২০ তারিখের পর থেকেই বাঙালি সেনারা বুঝতে পারেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বিশেষ করে ২৫ মার্চ কুখ্যাত অপারেশন সার্চ লাইটের আগের দিন থেকেই ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার উদ্যোগ নেয় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সেনা কমান্ড। প্রথম থেকেই প্রতিবাদ করতে থাকেন সৈনিকরা। তার সাথে যোগ দেন কর্মকর্তারাও।
রাজনৈতিক কোনো তৎপরতা না জেনেই ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ করেন করেন তারা। মার্চের ৩০ তারিখে এতে যোগ দেন যশোরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ। বলছিলেন কিভাবে শুরু হয় সেই প্রতিরোধ।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সাবেক মেজর হাাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম ক্যাপ্টেন) বলেন, এই ভয়াবহ সময়ে দেশের জনগণকে কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি তখনও, এগিয়ে এসেছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকেরা।
তিনি আরও বলেন,
যশোরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আমি একমাত্র বিরোধী অফিসার ছিলাম সেই সময়। যশোরের ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে ৮ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হয়। ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে থেকে বাইরে এসে দেখি হাজার হাজার যুবক দা, কুড়াল খুন্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন আমাদের বলেন অস্ত্র দেন স্যার, যুদ্ধ করবো। এই বাঙালির যে স্পিরিট, স্বাধীনতার জন্য তাদের যে আকুতি, তাদের সাহসী মনোবল দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম আমি।
শুধু পূর্ব বাংলায় থাকা সেনারা নয়, পশ্চিম পাকিস্তানে থাকারাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যোগ দেন প্রতিরোধ যুদ্ধে। সেরকমই একজন ক্যাডেট অফিসার হিসেবে প্রশিক্ষণরত মোদাসসের হোসাইন খান।
বীর প্রতীক কোম্পানি কমান্ডার, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ক্যাডেট অফিসার প্রশিক্ষণরত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোদাসসের হোসাইন খান বলেন, লুকিয়ে লুকিয়ে সংবাদ শুনতাম। ঘোষণার পর সিদ্ধান্ত নিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিবো। আমার সঙ্গে অনেকে মারা গেছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। আমাদের মৃত্যু কোনো ভয় ছিল না। আমাদের মাথায় একটাই চিন্তা ছিল দেশকে স্বাধীন করতে হবে।
সেনানিবাস থেকে জীবনবাজি রেখে বের হওয়ার পর এই সৈনিকরাই মন দেয় যুদ্ধ পরিকল্পনায়। এরপর ধীরে ধীরে যোগাযোগ হয় একে অপরের সঙ্গে।
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বলেন,
আমরা তখন ছাত্রদের দেড় মাস প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারপরই তারই দুঃসাহসী যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু রাজনীতিকরা সৈনিকদের কৃতিত্ব দিতে চান না। তারা মনে করেন তাদের বক্তৃতাতেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই নয় মাসের সংগ্রাম, জীবন বিপন্ন করে আত্মাহুতি দিয়ে এদেশের স্বাধীনতার জন্য কত জীবন অকালে ঝড়ে গিয়েছে। আমি ৫০০ জন ছাত্রকে নিয়েছিলাম প্রশিক্ষণের জন্য, তারমধ্যে ১০০ জন সম্মুখ যুদ্ধে জীবন দিয়েছে।
অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ সম্মুখযুদ্ধের ইতিহাস উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, আত্মত্যাগের মহিমায়। যেখানে হাজার হাজার বাঙালি সেনার বীরত্বগাথা অম্লান হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।