অনৈক্যের মাঝেই ভোটের হাওয়া

৩ সপ্তাহ আগে
অমীমাংসিত ইস্যুগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হতে এক সপ্তাহের সময় দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র মতবিরোধের মধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্তে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যে অনিশ্চয়তার রেখা দেখা যাচ্ছিলো সন্ধ্যায় বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর তা বদলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আবহ তৈরি হয়েছে। দেশ এখন অনেকটাই নির্বাচনমুখী।

গত ২৮ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয় তীব্র বিরোধ। সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েই মূল অনৈক্য দলগুলোর মধ্যে। সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ থেকে নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেয়াকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলছে বিএনপি, আর জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবি জানিয়েছে জামায়াত। এসব কারণে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথাও বলছে রাজনীতিকরা।


এমন প্রেক্ষাপটে সোমবার (৩ নভেম্বর) উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে বৈঠকের পর বিস্তারিত জানাতে সংবাদ সম্মেলন কনের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, বিরোধপূর্ণ বিষয় ও গণভোট নিয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাপ আলোচনা করে সরকারকে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত জানানোর আহ্বান জানান তিনি। অন্যথায় সরকার করণীয় ঠিক করবে বলেও জানান।


এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে সরকার আর সংলাপের আয়োজন করবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগেই নিজেদের মধ্যে সংলাপের ব্যবস্থা করতে হবে।


সরকারের এই বক্তব্যের পর প্রশ্ন ওঠে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আট মাস চেষ্টাও যেটা সম্ভব হয়নি সেই ‌‘ঐক্য’ এই সাত দিনে কীভাবে অর্জিত হবে? মুখোমুখি অবস্থানে থাকা দলগুলোকে এক টেবিলে বসাতে উদ্যোগটাই বা কে নেবে আর তাদের সংলাপে মধ্যস্থতাকারী বা ‘রেফারির’ ভূমিকায় বা কে থাকবে?


রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের সামনে এই প্রশ্নগুলো যখন নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা বাড়াচ্ছিলো ঠিক সেই পরিস্থিতিতে ২৩৭টি আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী আগেই তাদের প্রার্থীদের চূড়ান্ত করেছে। এনসিপিরও শীর্ষস্থানীয় নেতারা কে কোন আসন থেকে ভোট করবেন অনানুষ্ঠানিকভাবে তাও প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে অনৈক্যের মাঝে দেশে একরকম নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে।


এদিকে গণভোট ইস্যুতে দলগুলোকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল। এক্ষেত্রে তারা অবশ্য রেফারির অভাবের আশঙ্কা জানিয়েছেন। রাজধানীর পুরানা পল্টনে আট দলের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে, জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ইস্যুতে দলগুলোকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বান ইতিবাচক। অন্য দলগুলোও আমাদের মতো মনোভাব দেখালে এবং একসঙ্গে বসলে সমাধান বের হয়ে আসবে বলে আমি মনে করি। তবে সরকারকে রেফারির ভূমিকা পালন করতে হবে।


রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। রাজশাহীর বাসীন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, বিএনপি ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। জামায়াতও গত মে মাস থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। শুনেছি এনসিপিও ৩০০ আসনে প্রার্থী দিবে। বলা যায় সব দল তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে, তাতে যেন কোনো প্রকার অস্থিরতা বা সহিংসতা যেন না ঘটে।

 

আরও পড়ুন: গণমাধ্যমে আসা প্রার্থী তালিকা আনুষ্ঠানিক নয়: এনসিপি


ঢাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, গত কয়েক বছর ধরে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তা সবার জন্য উদ্বেগের। যদিও সরকার বলছে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এনসিপি, বিএনপি এবং জামায়াতের মতো বড় দলগুলোর নানা বিভাজন দেখা যাচ্ছে। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দেশের ভবিষ্যতের জন্য নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


নির্বাচনের আগে এনসিপি, জামায়াতসহ কয়েকটি দল গণভোট চাইলেও বিএনপি এর বিরোধিতা করছে। তারা এটি কোনোভাবেই মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই পরিষদ যদি ২৭০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ না করে, তাহলে সংস্কার বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে—এমন ধারণা হাস্যকর ও গণতান্ত্রিক রীতির পরিপন্থী। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি প্রস্তাব করেছে— নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজন করা হোক।


ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চেয়েছে এনসিপওি। তবে তার আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোট ইস্যুরও সমাধান চেয়েছে দলটি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জুলাই সনদের আদেশ জারি করার আহ্বান জানিয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।


ভোটের বাতাসে অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান কোন পথে?


আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন সময় বেঁধে দিলেও মধ্যস্থতাকারী না থাকলে দলগুলো আর বসবে না। তিনি বলেন, ‌‌‘সাত দিনের মধ্যে একসঙ্গে বসে ঐকমত্য হবে, এমন প্রস্তাব অবাস্তব। বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া নোট অব ডিসেন্ট না থাকা এবং যে প্রস্তাবে একমত হয়েছে সেগুলো পরবর্তীতে না থাকার বিষয়গুলো নিয়ে অভিযোগ ওঠা খুবই গুরুতর।’


তিনি বলেন, ‘তবে জুলাই সনদ এবং প্রস্তাবনার বিষয়ে গণভোট আয়োজন খুবই জটিল। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে আর যেগুলো নিয়ে একমত হওয়া যায়নি, সেসব বিষয়ে গণভোট আয়োজন করলে ১০ শতাংশ ভোট পড়বে কি না সন্দেহ।’


সংসদ কার্যকর হওয়ার আগে গণভোট আয়োজন আইনের প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী বলেও মনে করেন শাহদীন মালিক।


জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকার অধ্যাদেশ জারি করতে পারে কিনা, তা নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।

 

আরও পড়ুন: বিএনপির প্রার্থী তালিকায় নাম নেই যেসব হেবিওয়েট নেতার


ড. শরিফ ভূঁইয়া বলেন, সরকার প্রধান জারি করতে পারেন। তিনি যদি জারি করতে চান সেটার আইনগত ব্যাখ্যা দেয়া যায়। আর সরকার প্রধান জারি করতে না চাইলে রাষ্ট্রপতি করতে পারেন। এটা দু’ভাবেই সম্ভব বলে আমি মনে করি।


তবে শাহদীন মালিক বলছেন,

আইন পাস অথবা অধ্যাদেশ জারির এখতিয়ার নেই নির্বাহী বিভাগ প্রধানের। প্রধান উপদেষ্টা তো প্রধানমন্ত্রীর মতো, নির্বাহী বিভাগের প্রধান। নির্বাহী বিভাগের প্রধান কখনো আইন পাস করতে পারে না।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, আলোচনার জন্য সবগুলো দল যথেষ্ট সময় পেয়েছে। আগামী সাত দিন তাদের নতুন করে যে সময় দেয়া হয়েছে, সেখানে দলগুলোকে নিজের অবস্থান থেকে ছাড় দিতে হবে। তবে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা খারাপ। নির্বাচন করতে হবে, এক্সিট রোড পেতে হবে। সরকার মাঝামাঝি পথে হাঁটলে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতো দলের কথা শুনে সমন্বয় করে নির্বাচনের পথে হাঁটার চেষ্টা করবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাদেশ জারি করলে তা আইনের পথে টিকবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হাসান সময় সংবাদকে বলেন, ‘মূল সমস্যা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর অভিপ্রায় অনুযায়ী সরকারের সময়সীমা ঠিক না হওয়া। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, আস্থার অভাব। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আস্থার সংকট আছে। আবার সরকারের প্রতিও তাদের আস্থার ঘাটতি আছে। সরকারও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে কখনও কোনো দল খুশি হয়েছে, আবার কখনও কোনো দল অখুশি হয়েছে।’


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, 

বিএনপি চায় গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিন হোক। কিন্তু অন্যান্য দল চায় আগে হোক। কারণ তাদের ধারণা, নির্বাচনে জয় পেলে বিএনপি সেটি নাও দিতে পারে। একে অপরের প্রতি সন্দেহের কারণে এ সমস্যাটা হয়েছে।


ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চাইলে ডিসেম্বরেই ঘোষণা করতে হবে তফসিল। এর আগে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমানো, সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি আর গণভোট ইস্যুর মীমাংসা। আর সেই কারণেই নভেম্বরকে বিবেচনা করা হচ্ছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে।


এ বিষয়ে সোহরাব হাসান বলেন, ‘ডিসেম্বরে তফসিল হওয়ার কথা। তফসিল হওয়ার পর কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করলে, সেটি একটি কঠিন অবস্থা তৈরি করবে। সেই কারণে নভেম্বরেই সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে আস্থা তৈরি করতে হবে।’


আর অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী বলেন, রাজনীতিতে পর্দার অন্তরালে কিছু আলোচনা করতে হয়। সেভাবে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। তা না হলে অসুবিধা হবে।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন