হাসপাতালের আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) ও সিসিইউ (করোনারি কেয়ার ইউনিট) রয়েছে বন্ধের মুখে। জনবল সংকট, অনিয়মিত বেতন ও নিরাপত্তাহীনতায় চিকিৎসক-কর্মচারীরা দিশেহারা। এর মধ্যেই ৯৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। এখনও অবশিষ্ট ৮২ জন মানবিক বিবেচনায় বিনা বেতনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষায়িত বিভাগগুলো যেকোনো সময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরেজমিনে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আইসিইউতে ভর্তি ৭ জন রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে মাত্র ১ জন চিকিৎসক। তিনি বলেন, 'আইসিইউ নিজেই এখন মৃত্যুশয্যায়। ৯ মাস ধরে কোনো বেতন পাইনি। তবু মানুষের জন্য কাজ করছি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?'
আইসিইউ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কনসালটেন্ট ডা. কপিল উদ্দিন আব্বাস বলেন, ‘আমাদের সবাই বিনা বেতনে কাজ করছে। জুন মাসের পর যদি প্রকল্প না আসে, আমাদের সরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তখন আইসিইউ ও সিসিইউ বন্ধ হয়ে যাবে।’
হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও নেমেছে নৈরাজ্য। নেই নিরাপত্তারক্ষী, ফলে প্রতিদিন ঘটছে মারামারির ঘটনা। রোগী পক্ষের মধ্যে গোলযোগ লেগেই আছে।
হাসপাতালের আরএমও এস এম আশরাফুজ্জামান জানান, 'আগে জরুরি বিভাগে ১২ জন নিরাপত্তারক্ষী ছিল। বেতন না পেয়ে সবাই চলে গেছে। প্রতিদিন গড়ে একাধিক মারামারি হচ্ছে। চোর-ছিনতাইকারীদের আখড়া হয়ে গেছে জরুরি বিভাগ।'
আরও পড়ুন: হাটহাজারী-কর্ণফুলীতে দুটি হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা আছে: স্বাস্থ্য উপদেষ্টা
চিকিৎসা নিতে এসে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন রোগী ও স্বজনরা। কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল থেকে আসা আনোয়ার হোসেন বলেন, 'দুই দিন আগে ভর্তি হয়েছি, এখনো কোনো চিকিৎসক এসে দেখেননি।'
উখিয়া থেকে আসা হালিমা বলেন, 'সিট নেই, লিফটের পাশে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছি। হাসপাতালটা এখন অপরিষ্কার, অস্বাস্থ্যকর।'
২০১৯ সালে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিও ‘স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ সহায়তা প্রকল্প (এইচজিএসপি)’ চালু করে। এর আওতায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চালু হয় আইসিইউ, সিসিইউ, জরুরি প্রসূতি ও শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম। নিয়োগ দেওয়া হয় অতিরিক্ত ১৭৬ জন চিকিৎসক ও কর্মচারী।
কিন্তু ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে কিছুটা সরকারি তদবিরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের জন্য সময় বাড়ানো হয়। তারপর থেকে এই ৯ মাসে আর কোনো বরাদ্দ আসেনি। ৯৪ জন পদত্যাগ করলেও, অবশিষ্ট ৮২ জন এখনো বিনা বেতনে সেবা দিচ্ছেন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মং টিং ঞো বলেন, নতুন প্রকল্প 'ইনক্লুসিভ সার্ভিসেস অপারেটিং (আইএসও)' চালুর বিষয়ে আশ্বাস মিলেছে। তাই আমরা বিশেষায়িত বিভাগগুলো চালু রেখেছি। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক চিকিৎসক চলে গেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিশেষায়িত বিভাগগুলো মূলত এনজিও-নির্ভর। সরকারি নিয়ন্ত্রণে না থাকায় প্রকল্প বন্ধ হলে কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। সিসিইউ গত সপ্তাহে ৪ দিন বন্ধ ছিল, পরে ২ জন চিকিৎসককে এনে সাময়িকভাবে চালু রাখা হয়েছে।
চিকিৎসকদের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ লাখ স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি ২০১৭ সাল থেকে আশ্রয় নেওয়া ১৫ লাখ রোহিঙ্গা এবং প্রতিবছর কক্সবাজারে আগত কয়েক লাখ পর্যটক এই হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। অথচ ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে ভর্তি থাকে ৯০০ জন রোগী।
আরও পড়ুন: উখিয়া স্পেশালাইজড হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গড়ে ৫০০ এবং বহির্বিভাগে আড়াই হাজার রোগী সেবার জন্য আসে। তবে হাসপাতালটির সরকারি পদে ৩২৮ জনের অনুমোদন থাকলেও বর্তমানে ৭৬টি পদ শূন্য রয়েছে।
জনবল সংকট নিরসন, জরুরি ভিত্তিতে বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং স্থায়ী সরকারি নিয়োগ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা যদি প্রকল্প পুনরায় শুরু না করে, তাহলে সরকারি উদ্যোগেই এই বিভাগগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিকট জানানো হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্প অনুমোদন বিলম্ব হচ্ছে।
কক্সবাজারের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠকরা বলছেন, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের এই সংকট শুধু একটি জেলার নয়, বরং এটি একটি জাতীয় সংকট। এই হাসপাতালের পতন মানে ৪৫ লাখ মানুষ চিকিৎসার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। এখনই জরুরি ভিত্তিতে সরকারি হস্তক্ষেপ না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।