রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম ভাই-বোনেরা হজ পালন করে থাকেন। সর্বোচ্চ হজযাত্রী প্রেরণকারী দেশের তালিকায় আমাদের অবস্থান চতুর্থ। গতবছরও আমাদের দেশ থেকে ৮৭ হাজার ১০০ জন হজ পালন করেছেন। সামগ্রিক বিবেচনায় এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিশেষ করে যারা হজ পালনের জন্য নিয়্যত করেছেন তাদের মধ্যে হজ প্যাকেজ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ও কৌতূহল রয়েছে। আজ আমরা ২০২৬ সনের হজ প্যাকেজ ঘোষণার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে এসে উপনীত হয়েছি।
আরও পড়ুন: ২০২৬ সালের হজ প্যাকেজ ঘোষণা
বক্তব্যে তিনি বলেন, হজ দ্বি-রাষ্ট্রিক কার্যক্রম। রাজকীয় সৌদি সরকার ও হজযাত্রী প্রেরণকারী দেশসমূহের ব্যবস্থাপনায় হজ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে নীতি-নির্ধারণী বিষয়গুলোতে সৌদি সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। হজের রোডম্যাপ ঘোষণা, সৌদি প্রান্তে আবশ্যকীয় ব্যয় নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয় সৌদি সরকারের এখতিয়ারধীন। ২০২৬ সনের হজে সৌদি প্রান্তে আবশ্যকীয় ব্যয়ের চূড়ান্ত ব্যয়ের হিসাব না পাওয়ায় বিগত বছরের খরচের ধারাবাহিকতায় সম্ভাব্য খরচ হিসাব করে প্যাকেজ প্রণয়ন করা হয়েছে। পরবর্তীতে রাজকীয় সৌদি সরকার কর্তৃক কোনো খাতের খরচ বৃদ্ধি/হ্রাস করা হলে সে অনুসারে প্যাকেজ মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পাবে। প্যাকেজ মূল্য বৃদ্ধি পেলে হজযাত্রীদেরকে তা পরিশোধ করতে হবে। প্যাকেজ মূল্য হ্রাস পেলে উদ্বৃত্ত টাকা ফেরত প্রদান করা হবে। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত রয়েছেন, আমরা ২০২৫ সনের হজে সরকারি মাধ্যমের হজযাত্রীদেরকে ৮ কোটি ২৮ লক্ষ ৯০ হাজার ১৮৩ টাকা ফেরত দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, হজ প্যাকেজে সৌদি আরব পর্বের ব্যয়ের খাতসমূহের মধ্যে রয়েছে-
• মক্কা-মদিনায় বাড়ি/হোটেল ভাড়া,
• পরিবহন ব্যয়,
• জমজম পানি,
• মিনা-আরাফায় সার্ভিস চার্জ,
• ভিসা ফিস,
• স্বাস্থ্যবীমা,
• ইলেক্ট্রনিক্স ফিস,
• গ্রাউন্ড সার্ভিস ফিস,
• মিনার তাঁবু ভাড়া/ক্যাম্প ফিস,
• লাগেজ পরিবহন ব্যয় ও
• দমে শোকর খরচ।
বাংলাদেশ পর্বের ব্যয়ের খাতসমূহের মধ্যে রয়েছে-
• বিমান ভাড়া
• হজযাত্রীদের কল্যাণ তহবিল
• প্রশিক্ষণ ফি
• হজ গাইড
• অন্যান্য সার্ভিস
সৌদি আরব ও বাংলাদেশ পর্বের এই সকল ব্যয় যোগ করেই আমরা প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করেছি।
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, আসন্ন ২০২৬ সনের হজে হজযাত্রী পরিবহনে বিমান ভাড়া যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ
মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করেছি। হজযাত্রী পরিবহনকারী এয়ারলাইন্সের সাথে আমরা কয়েক দফা মতবিনিময় করেছি। আমি নিজে চারবার বেসমারিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টার সাথে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় করেছি এবং বহুবার অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও কথাবার্তা বলেছি।
বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের বিষয়ে বেসমারিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। গতবছর বিমান ভাড়া ছিলো এক লক্ষ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা। এবছর বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক লক্ষ ৫৪ হাজার ৮৩০ টাকা অর্থাৎ এবছর হজযাত্রী প্রতি বিমান ভাড়া ১২ হাজার ৯৯০ টাকা কমেছে। এছাড়া, বেসমারিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে হ্রাসকৃত ভাড়া আরো কমানোর বিষয়ে তৎপরতা চলমান রয়েছে মর্মে আমাদেরকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এবছর যে বিমান ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে গতবছরের ন্যায় বাংলাদেশ পর্বের ভ্যাট ও ট্যাক্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এগুলো গতবছর অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। এবছরও আমরা বাংলাদেশ পর্বের ভ্যাট ও ট্যাক্সকে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া বহির্ভূত রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগকে অনুরোধ করেছি।
ব্রিফিংয়ে তিনি আরও বলেন, ২০২৬ সনের হজে সৌদি সরকার স্বাস্থ্য বীমার পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে ১৩০ সৌদি রিয়াল যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ হাজার ২৭০ টাকা। মিনা ও আরাফায় তাঁবু ভাড়া ৪.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নুসুক মাসার প্লাটফর্মে 'দমে শোকর' বাবদ ৭২০ সৌদি রিয়াল তথা ২৩ হাজার ৬৫২ টাকা জমাদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এবছর প্রথমবারের মতো দমে শোকর বাবদ টাকা হজ প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করে প্যাকেজ ঘোষণা করা হচ্ছে।
এছাড়া, এবছর সৌদি রিয়ালের বিনিময় হারও বেড়েছে, গতবছর সৌদি রিয়াল ছিলো ৩২.৫০ টাকা, এবছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২.৮৫ টাকা। এবছর সরকারি মাধ্যমে একটি হজ প্যাকেজ-১ (বিশেষ), 'হজ প্যাকেজ-২' ও 'হজ প্যাকেজ-৩' শিরোনামে মোট তিনটি হজ প্যাকেজ নির্ধারণ করেছি।
হজ প্যাকেজ-১ (বিশেষ): এই প্যাকেজের হজযাত্রীদের মক্কায় হারাম শরীফের বহিরঙ্গণ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ মিটারের মধ্যে এবং মদিনায় মারকাজিয়া বা সেন্ট্রাল এরিয়ায় হাজীদের আবাসন সুবিধা দেযা হবে। এটাচড বাথরুমসহ একরুমে সর্বোচ্চ ৫ জনের আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে। মিনায় জোন-২ এ তাঁবুর অবস্থান হবে এবং মিনা-আরাফায় ডি+ ক্যাটাগরির সার্ভিসসহ মোয়াল্লেম কর্তৃক খাবার সরবরাহ করা হবে। এ প্যাকেজের খরচ ধরা হয়েছে ৬ লক্ষ ৯০ হাজার ৫৯৭ টাকা।
হজ প্যাকেজ-২: এটি হজ প্যাকেজ-১ এর চেয়ে কিছুটা সুলভ হজ প্যাকেজ। এই প্যাকেজের হজযাত্রীদের মক্কায় হারাম শরীফের বহিরঙ্গণ থেকে ১.২ কিলোমিটার হতে ১.৮ কিলোমিটারের মধ্যে এবং মদিনায় মারকাজিয়া বা সেন্ট্রাল এরিয়ায় হাজীদের আবাসন সুবিধা দেযা হবে। এটাচড বাথরুমসহ একরুমে সর্বোচ্চ ৬ জনের আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে। মিনায় জোন-২ এ তাঁবুর অবস্থান হবে এবং মিনা-আরাফায় ডি ক্যাটাগরির সার্ভিসসহ মোয়াল্লেম কর্তৃক খাবার সরবরাহ করা হবে। এ প্যাকেজের খরচ ধরা হয়েছে ৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ৮৮১ টাকা। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, সেটা হলো- হজ প্যাকেজ-১ ও হজ প্যাকেজ-২ এ নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ সাপেক্ষে মক্কা ও মদিনায় ২ ও ৩ সিটের রুম আপগেডেশন ও শর্ট প্যাকেজ সুবিধা গ্রহণ করা যাবে। হজযাত্রীদের সৌদি আরব অবস্থানকাল হবে সাধারণত ৩৫-৪৭ দিন। তবে শর্ট প্যাকেজে সৗদি আরবে অবস্থান কাল হবে ২২-৩০ দিন।
হজ প্যাকেজ-৩: এটি সাশ্রয়ী হজ প্যাকেজ। এই প্যাকেজের হজযাত্রীদের আবাসন হবে মক্কায় আজিজিয়া এলাকায় এবং মদিনায় মারকাজিয়া এলাকার বাইরে। একরুমে সর্বোচ্চ ৬ জনের আবাসনের ব্যবস্থা থাকবে। মিনায় জোন-৫ এ তাঁবুর অবস্থান হবে এবং মিনা-আরাফায় ডি ক্যাটাগরির সার্ভিসসহ মোয়াল্লেম কর্তৃক খাবার সরবরাহ করা হবে। হারাম শরীফে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য যাতায়াতের নিমিত্ত এসি বাসের বন্দোবস্ত থাকবে। এ প্যাকেজের খরচ ধরা হয়েছে ৪ লক্ষ ৬৭ হাজার ১৬৭ টাকা।
এই প্যাকেজটি সরকারি মাধ্যমে হজযাত্রীদের জন্য নতুন সংযোজন। এর আগে কখনও সরকারি মাধ্যমের হাজীদেরকে আজিজিয়া এলাকায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে সর্বোচ্চ হজযাত্রী প্রেরণকারী তিনটি দেশ ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার হজযাত্রীদেরকে বহুবছর ধরে আজিজিয়া এলাকাতেই রাখা হয়।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া, আমাদের দেশের হজযাত্রীদেরকে দীর্ঘবছর যাবৎ যে এলাকায় রাখা হতো এই এলাকার হোটেল বা বাড়িগুলো সৌদি সরকার ভেঙে ফেলেছে। এ কারণে আগামীতে আমাদের দেশের হজযাত্রীদেরকে আজিজিয়া এলাকায়ই রাখতে হবে। হজ এজেন্সিসমূহের জন্য 'বেসরকারি মাধ্যমের সাধারণ হজ প্যাকেজ' শিরোনামে একটি প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্যাকেজের খরচ ধরা হয়েছে ৫ লক্ষ ৯ হাজার ১৮৫ টাকা। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এই
প্যাকেজটি গ্রহণ করে এজেন্সিসমূহ অতিরিক্ত দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারবে।
তিনি যুক্ত করেন, প্রত্যেক হজযাত্রীর খাবার বাবদ প্রতিদিন ন্যূনতম ৩৫ সৌদি রিয়াল ব্যয় হতে পারে। এ হিসাব অনুসারে খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা হজযাত্রীদেরকে সঙ্গে নিতে হবে এবং নিজ দায়িত্বে খাবার ক্রয় করতে হবে।
আরও পড়ুন: হজের প্রাথমিক নিবন্ধন শেষ ১২ অক্টোবর, বাড়বে না সময়: ধর্ম মন্ত্রণালয়
এদিকে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২০২৬ সনের ২৬ মে পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। আসন্ন ২০২৬ সনে আমাদের দেশ হতে সম্ভাব্য ১২৭,১৯৮ জন হজ পালন করতে পারবেন। ২৭ জুলাই ২০২৫ খ্রি. হতে হজের প্রাথমিক নিবন্ধন শুরু হয়েছে এবং সৌদি সরকারের রোডম্যাপ অনুসারে ১২ অক্টোবর ২০২৫ খ্রি. হজের নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ হবে। ১২ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তি ২০২৬ সনের হজে গমন করতে পারবেন।
তিন লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়ে প্রাথমিক নিবন্ধন সম্পন্ন করা যাবে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখের মধ্যে প্যাকেজমূল্যের সমুদয় অর্থ আবশ্যিকভাবে জমা প্রদান করতে হবে। ৯ নভেম্বর ২০২৫ খ্রি, হজচুক্তি সম্পাদিত হবে। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাড়িভাড়া ও পরিবহন চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ খ্রি. হতে হজ ভিসা ইস্যুর কার্যক্রম শুরু হবে। ১৮ এপ্রিল ২০২৬ খ্রি. হতে হজ ফ্লাইট শুরু হবে।
ধর্ম উপদেষ্টা হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এদেশের গণমাধ্যমসমূহ সর্বদা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করায় সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানান।
]]>