হৃদয় পবিত্র করণে আল কোরআন

৩ সপ্তাহ আগে
পবিত্র কুরআন এমন এক ঐশীগ্রন্থ যার ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে এতে কোনরকম বিকৃতি ঘটবে না। আজ পর্যন্ত আল্লাহপাক শব্দ ও অর্থের দিক দিয়ে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে আসছেন।

পবিত্র কুরআনের আর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল যে এতে সকল দেশ, জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মানুষের জন্য বার্তা রয়েছে। কুরআন সকল ধর্মের নবীকেই সত্য নবী এবং তাদের ধর্মগ্রন্থকে তাদের সময়ের জন্য সঠিক বলে ঘোষণা দেয়। 
হজরত রাসুল করিম (সা.)এর আগমনের সময় আরবজাতি চরম অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত ছিল। বাকি বিশ্বও এই অন্ধকার থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। এই চরম বিশৃঙ্খল ও অন্ধকারচ্ছন্ন সময়ে আরবের মাটিতে সূর্যের উদয় হয়। পবিত্র কুরআন অন্ধকারচ্ছন্ন আরব জাতিকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলে এবং তারা পরবর্তীতে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়। 
পবিত্র কুরআন স্বল্প সময়ে আরব জাতির মধ্যে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করে। এতে তারা এক আল্লাহর ইবাদতকারীতে পরিণত হয়। কুরআনে সুরা আল ফুরকানে তাদের সম্বন্ধে বলেছে “রহমানের প্রকৃত বান্দা তারা, যারা তাদের প্রভুর সমীপে সেজদাবনত ও দণ্ডায়মান অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করে” (২৫:৬৫-৬৬)। 
হজরত উমর (রা.) ইসলামের একজন মহান খলিফা হয়েছিলেন এবং তার সময়ের একজন মহান শাসক ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে পবিত্র কুরআনের বাণী শোনার মাধ্যমে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এটি কুরআনের এক বিপ্লব, যে উমর (রা.) পূর্বে ইসলামের চরম শত্রু ছিলেন তাকেও কুরআন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলে। তিনি আনুগত্যে এতটাই অগ্রসর হয়ে যান যে পরবর্তীতে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হন।
একইভাবে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.) যিনি ইসলামের মহান শাসক ছিলেন এবং যার সময়ে ইসলামিক সাম্রাজ্য মদিনা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল, তিনিও পবিত্র কুরআনের আয়াত শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। 
মহানবীর (সা.) সাহাবি হযরত ইবনে আব্বাস (সা.) বলেন সে যখন হযরত জাফর ইথিওপিয়া থেকে ফিরে আসছিলেন তখন তার সাথে কয়েকজন খ্রিষ্টান নাবিক ছিল। মহানবীর (সা.) কুরআন তেলাওয়াত শুনে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে এবং তারা সেই মুহুর্তেই ইসলাম গ্রহণ করে। মহানবি (সা.) জানতে চান যে ইথিওপিয়াতে গিয়ে তারা কি আবার তাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যাবে কিনা। তারা বলে যে তারা কখনো ইসলামকে পরিত্যাগ করবে না। 
এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে পবিত্র কুরআন সকল প্রকারের অন্ধকারকে আধ্যাত্মিক আলোতে রূপান্তর করেছে। 
এখন আমি পবিত্র কুরআনের এমন এক বিপ্লবের কথা বলব যা মানবতা, নাগরিক অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি, সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে। 
পবিত্র কুরআন মানবাধিকারকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যেটি পূর্বে কোন ধর্মগ্রন্থ করেনি। এটিই প্রথম এবং একমাত্র কিতাব যা কেবল নারীদের পক্ষে কথাই বলেনি বরং নারীদের অধিকারকেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। আল্লাহপাক সুরা নিসায় বলেছেন “এবং যে কেউ সৎ কাজ করে, সে পুরুষ হোক বা নারী এবং সে মোমেন, এই প্রকারের ব্যক্তিগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্রও অন্যায় করা হবে না” (৪:১২৬)।
ইসলামের পূর্বে কিছু আরব গোত্রে সম্মানের নামে মেয়ে সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া হত। ইসলাম চিরতরে এই প্রথাকে বিলুপ্ত করে এবং মহানবি (সা.) ঘোষণা দেন যেব্যক্তি তাদের কন্যাদের বড় করবে এবং শিক্ষা প্রদান করাবে, পবিত্র কুরআন ঘোযণা দিচ্ছে যে তাদেরকে জান্নাতে স্থান দেয়া হবে। 
ইসলামের পূর্বে নারীদের সম্পদের মালিকানা ছিল না কারণ তাদেরকেই পুরুষদের সম্পত্তি মনে করা হত। এমনি বিধবাদেরও মৃত স্বামীর সম্পতি হিসেবে বন্টন করা হত এবং তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপরে তাদের কোন মতামত দেবারই অধিকার ছিল না। ইসলাম নারীদের উত্তরাধীকারের অধিকার প্রদান করে, যার ফলে তারা নিজেদের ঘরের রাণী হয়ে থাকে। মহানবি (সা.) স্ত্রীদের সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বলেন “তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উত্তম যে তার স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে এবং আমি তোমাদের মধ্যে স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম।” 
পবিত্র কুরআন ১৪০০ বছর পূর্বে নারীদের অধিকার প্রদান করেছে। আর বর্তমান উন্নত বিশ্ব কিছুদিন হল নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলছে এবং এজন্য গর্ববোধ করছে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য পবিত্র কুরআনের মূলনীতি হল যেসব বিষয়ে ধর্মের মধ্যে মিল রয়েছে সেগুলোর জন্য একত্র হওয়া। 
হজরত রাসুল করিম (সা.) যখন মদিনায় যান তখন তিনি কুরআনের এই শিক্ষার ওপর আমল করেন। তিনি মদিনার ইহুদি, মুসলমান ও পাগানদের সাথে এক চুক্তি করেন যেটি মদিনা সনদ হিসেবে স্বীকৃত। 
পবিত্র কুরআন আমাদের শিক্ষা দেয় আমরা যেন সকল ধর্মের মানুষ ও তাদের নবি ও সন্ন্যাসীদের সম্মান করি এবং পারস্পরিক সহনশীলতার পরিবেশ গড়ে তুলি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন “ধর্মের ব্যপারে কোন বল প্রয়োগ নেই” (২:২৫৮)। 
মদিনা সনদে ইসলামের এই শিক্ষা দেখা যায়, যার মাধ্যমে সকল মানুষের অধিকার, ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা হয়। এই সনদ সকল ধর্মের মানুষকে তাদের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করে যার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ ও একতাবদ্ধ দেশ গড়ে উঠে। 
একইভাবে নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে যে চুক্তি হয় তাতেও একই শিক্ষার অনুসরণ করা হয়। সেখানে বলা হয় সকল ধর্মযাজক, ইবাদতের স্থান ও সেখানে বসবাসরত মানুষকে আল্লাহ ও তার নবী (সা.) পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করবেন। কোন ধর্মযাজককে তার ইবাদতের স্থান থেকে সরানো হবে না। 
পবিত্র কুরআনে সুরা আল মায়েদায় আল্লাহপাক বলেন “হে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায়পরায়ণতার ওপর সাক্ষী হিসেবে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হও, এবং কোন জাতির শত্রুতা যেন তোমাদেরকে এই অপরাধ করতে আদৌ প্ররোচিত না করে, যে তোমরা ন্যায়বিচার না কর। তোমরা সুবিচার কর, এটা তাকওয়ার অধিকতর নিকটবর্তী” (৫: ১০)।
কুরআনের এই আয়াত ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ মানদণ্ড নির্দেশ করে। এই শিক্ষা নামধারী মুসলমানকে ইসলামের নামে অত্যাচার ও নৃশংসতা করার কোন সুযোগ দেয় না। যারা ইসলামকে হিংস্র ও সন্ত্রাসী ধর্ম বলে প্রমাণ করতে চায় তাদেরও এই শিক্ষা কোন সমালোচনা করার সুযোগ দেয় না। কারণ এই আয়াতে পবিত্র কুরআন ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেছে। 
মহানবী (সা.) এরকম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে কোন বিশেষ দল তার কাছে কোন বিশেষ অনুগ্রহ পেত না, কারণ আল্লাহপাক এরকম পক্ষপাতিত্বহীন আচরণেরই নির্দেশ দিয়েছিলেন। 
বর্তমান বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে, পবিত্র কুরআন কীভাবে সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের মানুষের হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধন করেছিল । পবিত্র কুরআন মানুষের হৃদয়গুলোকে কীভাবে পবিত্র পরিবর্তন সাধন করেছিল। 
পবিত্র কুরআন যে মহান আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করেছে এবং আজো করছে আমরাও যেন তা থেকে কল্যাণমণ্ডিত হতে পারি। আল্লাহপাক আমাদের সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: কলামিস্ট

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন