হাবশায় যেভাবে ইসলামের আলো পৌঁছে

৩ সপ্তাহ আগে
মক্কার বুকে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অত্যাচারের হাহাকার। যারা এক আল্লাহর ইবাদত করত, যারা সত্যের পথে চলত, তারা নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত। কুরাইশদের রোষাণল এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে অনেক সাহাবি শহিদ হয়েছিলেন।

এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রিয় সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা হাবশায় চলে যাও। সেখানে একজন ন্যায়পরায়ণ রাজা আছেন, তাঁর দেশে কারো প্রতি জুলুম করা হয় না।(সিরাতু ইবনি হিশাম:১/৩১৯) এভাবেই শুরু হয় ইসলামের ইতিহাসে প্রথম হিজরত, হিজরতে হাবশা।

 

হিজরতের প্রেক্ষাপট

 

যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র ও অসহায়। আবু জাহল, উতবা, উমাইয়া, উকবা ইবনু আবি মুয়াইত প্রমুখ কুরাইশ নেতা একে একে তাঁদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালাত। বিলাল ইবনু রাবাহ রা.-কে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর ওপর ফেলে বুকের ওপর ভারী পাথর চাপিয়ে দেওয়া হতো। খব্বাব ইবনুল আরাত রা.-এর পিঠে লালচে কয়লা রেখে পোড়ানো হতো। 

 

সুমাইয়া রা., ইসলামের প্রথম শহিদা, আবু জাহলের বর্শার আঘাতে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। এই নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে প্রিয় নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের হাবশায় হিজরত করতে নির্দেশ দিলেন।

 

প্রথম হিজরত হাবশা

 

প্রথম হিজরতে অংশ নেন ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা। তাদের মধ্যে ছিলেন, উসমান ইবনু আফফান রা. ও তার স্ত্রী রুকাইয়া রা., আবু হুজাইফা রা. ও তার স্ত্রী সাহলা রা., জাফর ইবনু আবি তালিব রা., আবদুর রহমান ইবনু আওফ রা.,জুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. প্রমুখ। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা বসে থাকেনি। তারা নাজাশির কাছে দূত পাঠালো এবং দাবি করল যে সাহাবিদেরকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

 

আরও পড়ুন: নবীজির প্রতি দরুদ পাঠের ৫ ফজিলত


নাজাশির দরবারে ইসলামের প্রথম আলো

 

হে মহারাজ! আমাদের জাতির কিছু লোক আমাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে এমন এক নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছে, যা আমরা জানি না, আপনি-ও জানেন না। তারা আপনার দেশে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা চাই, আপনি তাদের আমাদের হাতে তুলে দিন, যাতে আমরা মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি। রাজপ্রাসাদে নীরবতা নেমে এলো। নাজাশি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে সাহাবিদের ডেকে পাঠালেন। দরবারে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত, অবসন্ন অথচ ঈমানের জ্যোতিতে আলোকিত সেই ছোট্ট দলটির দিকে রাজা স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,

 

তোমরা কোন ধর্ম অবলম্বন করেছ? এটি না আমাদের ধর্ম, না কুরাইশদের ধর্ম,তাহলে সত্যটা কী?


সেই মুহূর্তে সাহাবিদের হৃদয়ে যেন ঢেউ খেলে গেল। সবার চোখ জাফর ইবনু আবি তালিব রা.-এর দিকে নিবদ্ধ হলো। তিনি আস্তে আস্তে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখে বিনয়, চোখে অশ্রু, কণ্ঠে দৃঢ়তা। গভীর আবেগমাখা কণ্ঠে তিনি বললেন,

 

হে ন্যায়পরায়ণ মহারাজ! আমরা ছিলাম এক পথভ্রষ্ট জাতি। মূর্তি পূজা করতাম, মৃত প্রাণী খেতাম, অশ্লীলতা করতাম, শক্তিশালীরা দুর্বলদের পিষে ফেলত। তখন আল্লাহ আমাদের মাঝে একজন রসুল প্রেরণ করলেন, যিনি আমাদের এক আল্লাহর ইবাদত শেখালেন, সত্যবাদিতার শিক্ষা দিলেন, রক্তপাত নিষিদ্ধ করলেন, প্রতিবেশীর হক আদায় করতে বললেন, এবং আমাদের আত্মাকে পবিত্রতার পথে ডেকে নিলেন। কিন্তু আমাদের জাতি তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীদের ওপর নির্যাতন শুরু করল। আমরা নিরাপত্তা খুঁজে বেরিয়েছিলাম, আর তাই আপনার দেশে আশ্রয় নিয়েছি। (সিরাতু ইবনি হিশাম:১/৩২৩)

 

কুরআনের আলো নেমে এলো দরবারে

 

নাজাশি বললেন,

 

তোমাদের নবি আল্লাহ সম্পর্কে কী শিক্ষা দেন? জাফর রা. তখন সুরা মারইয়াম-এর সেই আয়াতগুলো তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন, যেখানে মারইয়াম ও ঈসা আ. সম্পর্কে কুরআনের ব্যাখ্যা রয়েছে, وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انْتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَانًا شَرْقِيًّا (সুরা মারইয়াম:১৬) 

 

যখন দরবারে কুরআনের সুর বেজে উঠল, তখন সবার চোখে অশ্রু নেমে এলো।  নাজাশির চোখে অশ্রু ভরে গেল, এমনকি তাঁর দাড়ি ভিজে গেল। তিনি বললেন,আল্লাহর কসম! এই কুরআন এবং ঈসা আ. -এর আনা শিক্ষা একই উৎস থেকে এসেছে। (সহিহ বুখারি: ৪৭৬৯)


নাজাশির রায়

 

নাজাশি কুরাইশের দূতদের বললেন,

 

তোমরা যা নিয়ে এসেছ, আমি তা ফিরিয়ে দিলাম। আল্লাহর কসম! আমি এই সৎ লোকদের (মুসলমানদের) কখনোই তোমাদের হাতে তুলে দেব না। এরপর সাহাবিরা নিরাপদে হাবশায় থেকে ইসলাম চর্চা চালিয়ে যেতে লাগলেন।

 


নাজাশির ঈমান গ্রহণ

 

পরে নাজাশি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন। সহিহ বুখারিতে এসেছে, রসুলুল্লাহ সলল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে বললেন,

 

আজ এক নেককার ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। তোমরা তাঁর জন্য গায়েবানা জানাজা পড়ো। (সহিহ বুখারি,: ১৩৩৩) রসুলুল্লাহ সলল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার মসজিদে নাজাশির জানাজা পরিচালনা করেন।

 

ইতিহাসের শিক্ষা

 

১. ইসলামের আলো কোনো শক্তি থামাতে পারে না। ২.সত্য কথা সর্বদা হৃদয় স্পর্শ করে। ৩.ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক ছিলেন নাজাশি। ৪.আল্লাহর পথে ত্যাগ ও ধৈর্য শেষ পর্যন্ত বিজয় বয়ে আনে।


যে দরবারে আগে ইসলামের নামই উচ্চারিত হয়নি, সেখানে কুরআনের আলো নেমে এসেছিল। নাজাশির দরবারে সত্যের জয় হয়েছিল। আর সেই জয় আজও পৃথিবীর প্রতিটি সত্যপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালায়।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন