পাটের ভাগ্য ফিরছে না, তবুও পাটের গন্ধে এক অদ্ভুত মায়া রয়েছে। ফরিদপুরের কৃষক আবু বকর সিদ্দীক সেই মায়া ছাড়তে পারেন না। তিনি বলেন, ব্যাপারী ও কোম্পানির লোকেরা সৎ নয়। তবে যখন চীন সরাসরি আমাদের দেশ থেকে পাট কিনেছিল, তখন প্রতিটি কৃষকই ন্যায্য দাম পেয়েছিল।
কৃষকদের কাছে সেই বছরটি এখন রূপকথার মতো। সেই লাভ এখন আর কেউ চোখে দেখে না। চাষিরা বলেন, বর্তমানে পাটের দাম মণপ্রতি ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার টাকা। অথচ যদি দাম ৬ হাজার টাকা হতো, কৃষকদের কিছুটা হলেও লাভ হতো।
আরও পড়ুন: পাটচাষির আক্ষেপ / ‘পাটের ব্যাপারীরা স্টক রেখে উচ্চ দামে বিক্রি করেন, আমরা ন্যায্য দাম পাই না’
আবু সিদ্দিক ও হরিচন্দ্রের উৎপাদিত পাট দিয়ে খুলনার উদ্যোক্তা রাশেদ রেজা ব্যাগ তৈরি করেন। বিশ্বমানের এই পাট দিয়ে তৈরি রফতানিযোগ্য ৩টি ব্যাগের সমান মূল্যে পাওয়া যায় মাত্র এক মণ পাট। ব্যাগ তৈরির উপকরণ যেমন বেত, চামড়া, কাঠ, সুতা সবই দেশীয়। কাঁচামাল থেকে চূড়ান্ত পণ্য তৈরির এ প্রক্রিয়া বিশ্ববাজারে ‘হাই ভ্যালু অ্যাডেড’ বা উচ্চ মূল্যসংযোজন পণ্য হিসেবে পরিচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলো, উৎপাদিত পাটের প্রায় ৯৫ শতাংশই কাঁচামাল আকারে রফতানি হয়ে যায়।
উদ্যোক্তা রাশেদ বলেন, আমাদের তৈরি পাটের ব্যাগ সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব সম্পদ, এখানে অন্য কারো কোনো অধিকার নেই। অন্য কোনো উপাদান ব্যবহার হয় না। ১০০ শতাংশ মেইড ইন বাংলাদেশ।
২০২৪ সালে শুধু কাঠ, বাঁশ, বেত, মাদুর রফতানি করে ইন্দোনেশিয়া আয় করেছে ২.২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা বিশ্বের মোট চাহিদার ১৫ শতাংশ পূরণ করে। অথচ বাংলাদেশের বিশ্ববাজারে অবস্থান এখনো নগণ্য। এসএমই ফাউন্ডেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. মফিজুর রহমান বলেন, জাপান, চীন ও কোরিয়ার মতো দেশগুলো তাদের ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলোকে যেভাবে যত্ন করে লালন করেছে, বাংলাদেশ তা করতে পারেনি। অথচ পাট, পাটজাতীয় পণ্য, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেতের কাজ-সবই আমাদের বিশাল সম্পদ।
বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড নাইকি, গুচি, জারা, ম্যাকডোনাল্ডস, কালে টাইলসসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখন পরিবেশবান্ধব ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। ৭৫ হাজার কোটি ডলারের এই বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ১ শতাংশেরও কম। অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, আধুনিক বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে আছে। অথচ ভারত ও চীন আমাদের দেশ থেকেই পাট কিনে উচ্চমানের পণ্য তৈরি করছে এবং বিশ্ববাজার দখল করছে।
ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম নিজেদের দেশীয় পণ্য ও ঐতিহ্যকে সামনে এনে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশের কুটির শিল্প ও চারুকলাতেও নিজস্বতা রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বড় সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। ড. মফিজুর রহমান বলেন, কাঁচামাল, দক্ষতা ও জনবল থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা ফিনিশিং মানে পিছিয়ে আছি। তাই কারিগরদের আরও উন্নত প্রশিক্ষণ এবং উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে। থাইল্যান্ডে এসএমই খাতের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে, যেখানে উদ্যোক্তাদের মাত্র ১ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: বন্ধ ৭৫ হাজার কারখানা, ডুবতে বসেছে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্প!
অর্থনীতিবিদদের মতে, পোশাক খাতে যেখানে প্রায় ৪০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, সেখানে হস্তশিল্পে সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করা সম্ভব। কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষ জনবল তৈরি করে এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে শতভাগ লাভের বাজার তৈরি করা সম্ভব। অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন,বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কটেজ ইন্ডাস্ট্রির পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দাম পেতে পারে। এজন্য বৈচিত্র্যময় ও আধুনিক মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি, গ্লোবাল ডিজাইনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের বাঁশ, বেত, কাঠ ও পাটভিত্তিক শিল্প কাঁচামাল ও জনবল উভয় ক্ষেত্রেই স্বনির্ভর। বৈশ্বিক পরিবেশ-সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে কৃত্রিম তন্তু ও ক্ষতিকর উপাদান থেকে তৈরি পণ্যের ব্যবহার দিন দিন কমছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও এখন সবুজ অর্থায়ন ও টেকসই বিকল্প উপকরণের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ চাইলে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিতে পারে, তবে এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সুনির্দিষ্ট রফতানি কৌশল প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
]]>