হঠাৎ রাস্তা ধসে বিশাল গর্ত হচ্ছে কেন?

৬ দিন আগে
রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছেন, হঠাৎ চোখের সামনেই মাটি ধসে তৈরি হলো এক বিশাল গর্ত! ভাবুন তো কি ভীতিকর একটা ব্যাপার! সম্প্রতি ব্যাংককে এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালের সামনের রাস্তা ধসে প্রায় ৯০ ফুট চওড়া এবং ১৬০ ফুট গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গতবছর ভারতে এবং কিছুদিন আগে বাংলাদেশেও এমন ঘটনা চোখে পড়ে। এই ঘটনাগুলো এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায়শই ঘটছে। বিজ্ঞানের ভাষায় যেটা পরিচিত সিঙ্কহোল নামে।

এই সিঙ্কহোল আসলে কী? এটা কেন হয়? আর হঠাৎ করে এমন ঘটনা বাড়ছেই বা কেন? চলুন জানার চেষ্টা করি।


সিঙ্কহোল কী?

 

সহজ ভাষায় বললে, সিঙ্কহোল হলো মাটির উপরিভাগের হঠাৎ করে ধসে পড়ার ফলে সৃষ্ট একটি গর্ত। এটি সাধারণত এমন সব জায়গায় দেখা যায়, যেখানে মাটির নিচে চুনাপাথর, কার্বনেট শিলা, লবণ বা অন্যান্য দ্রবণীয় শিলা থাকে। এই শিলাগুলো যখন ভূগর্ভস্থ পানির সংস্পর্শে আসে, তখন ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। একসময় মাটির নিচে একটা বিশাল ফাঁপা জায়গা তৈরি হয়। যখন উপরিভাগের মাটি এই ফাঁপা অংশকে আর ধরে রাখতে পারে না, তখন এটি হঠাৎ করে ধসে পড়ে এবং সিঙ্কহোলের সৃষ্টি হয়।


সিঙ্কহোল কেন হয়?


সিঙ্কহোল হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ আর ক্ষয়, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, অতি বৃষ্টি বা বন্যা, খনি বা টানেল খনন এবং ভূগর্ভস্থ শিলার রাসায়নিক ভাঙন।


তবে বৃহৎ আকারে সহজ ভাষায় বললে সিঙ্কহোলের প্রধান কারণ দুইটি: প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট।


প্রাকৃতিক কারণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহের কারণে মাটির নিচে শিলা ক্ষয় হয়। বিশেষ করে যখন দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, তখন মাটির নিচের ফাঁপা অংশটি দুর্বল হয়ে যায় এবং ধসে পড়ে।


মানবসৃষ্ট কারণগুলো হলো-


অপরিকল্পিত নির্মাণ: বড় বড় ভবন বা অবকাঠামো তৈরির সময় মাটির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে।

 

ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন: কৃষি বা শিল্প কারখানার জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে নিলে মাটির নিচের পানির স্তর নিচে নেমে যায়, ফলে ফাঁপা অংশগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।

 

পাইপের লিকেজ: পুরোনো বা ক্ষতিগ্রস্ত পানির পাইপ থেকে লিকেজ হলে মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

 


হঠাৎ এমন ঘটনা বাড়ছে কেন?

 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিঙ্কহোলের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। তীব্র বৃষ্টিপাত এবং বন্যা মাটির নিচের শিলা ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে।


অন্যদিকে, খরাপ্রবণ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে; যা সিঙ্কহোল সৃষ্টির জন্য সহায়ক। তাই বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার বৈরি আচরণ এবং কিছু মানবসৃষ্ট কারণ এই ধরনের ঘটনা বাড়িয়ে তুলছে।


বিশ্বে সিঙ্কহোলের ঘটনা:


সিঙ্কহোল কোনো একক দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ফ্লোরিডা এবং টেক্সাসের মতো জায়গায় সিঙ্কহোল খুব সাধারণ। এছাড়াও চীন, মেক্সিকো, ইতালি, তুরস্ক এবং জর্ডানেও বড় বড় সিঙ্কহোল দেখা গেছে।


এশিয়ায় সিঙ্কহোলের ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম হলেও, চীন, ভারত এবং ভিয়েতনামে বিভিন্ন সময় সিঙ্কহোল দেখা গেছে। থাইল্যান্ডে সম্প্রতি সিঙ্কহোলের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রায় ১৬০ ফুট গভীর গর্ত তৈরি করে।


বাংলাদেশে সিঙ্কহোলের সম্ভাবনা


বাংলাদেশে সিঙ্কহোলের ঘটনা খুব একটা শোনা যায় না। তবে সম্প্রতি কিছু ছোট আকারের সিঙ্কহোল দেখা গেছে। বাংলাদেশের মাটির গঠন বেশিরভাগই পলিমাটি এবং নদীবিধৌত সমভূমি দিয়ে গঠিত, যা সিঙ্কহোল সৃষ্টির জন্য আদর্শ নয়। তবে কিছু কিছু অঞ্চলে, যেখানে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে অথবা পুরোনো পানির পাইপলাইন আছে, সেখানে ছোট আকারের সিঙ্কহোল হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।


যদি কোনো বড় আকারের সিঙ্কহোল হয়, তাহলে এর ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক হতে পারে। বড় অবকাঠামো, যেমন- রাস্তা, বাড়ি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস লাইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

 

আরও পড়ুন: সাগরের ঢেউয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত


গবেষণা কী বলছে?


ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এবং মাটির আর্দ্রতার পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে এমন সব স্থানেও সিঙ্কহোল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে, যেখানে আগে কখনোই হয়নি। বিজ্ঞানীরা এখন স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির নিচে কোনো বড় ফাঁপা অংশ আছে কিনা তা শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন, যাতে সম্ভাব্য বিপদ আগে থেকে জানা যায়।


পাউবো'র সাবেক পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ বলছেন, বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া ঢাকা সিটিসহ দেশের বেশিরভাগ জায়গার অগভীর ভূগর্ভ বালুকণা আর কাঁদামাটির স্তর দিয়ে গঠিত। ফলে প্রাকৃতিকভাবে এখানে বড় ধরনের সিঙ্কহোল হওয়ার আশঙ্কা নেই। ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে মাটি সামান্য বসে যেতে পারে, কিন্তু তা খুবই নগণ্য। তবে ভূগর্ভে নির্মাণজনিত ত্রুটি বা চট্টগ্রামের মতো পাহাড়ি এলাকায় টেকটনিক ফাটল থাকলে ভূমিধ্বস ঘটতে পারে।


তবে সঠিক ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা ও সতর্কতা মানলেই বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন