স্বামী হিসেবে যেমন ছিলেন নবীজি

১ সপ্তাহে আগে
মানবজীবনের সকল সম্পর্কেই আদর্শ আচরণের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত রেখেছেন, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বিশেষ করে স্বামী হিসেবে তাঁর চরিত্র ছিল উপমাহীন, স্নেহময় ও দায়িত্বশীল। তিনি কখনো পরিবারের ওপর রাগ, জুলুম বা অবহেলা চাপিয়ে দেননি।

বরং ভালোবাসা, ধৈর্য ও সৌজন্যের মাধ্যমে পরিবারের বন্ধনকে শক্ত করে তুলেছেন। বর্তমান সমাজে অনেক স্বামী নানা ভুল আচরণের কারণে সংসারকে জটিল ও অশান্ত করে তুলে। তাই নবীজির দাম্পত্য আচরণ থেকে শিক্ষা নেয়া সময়ের দাবি। তাঁর জীবনযাপন বুঝতে পারলে ,আজকের স্বামীদের নিজেদের ভুল বুঝে সংশোধন করার সুযোগ তৈরি হবে।


নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের সাথে সবসময় কোমল, বিনয়ী ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতেন। কখনো কঠিন ভাষা ব্যবহার করতেন না। তিনি বলেন,

 

তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার পরিবার -পরিজনের কাছে উত্তম।আর আমি পরিবারের কাছে সবচেয়ে উত্তম। (তিরমিজি: ৩৮৯৫; দারিমি: ২৩০৬) এই বাক্যেই বোঝা যায়।মানুষের প্রকৃত উত্তমত্ব প্রকাশ পায় তার পরিবারের সাথে আচরণের মাধ্যমে। জীবনের নানা চাপে থেকেও তিনি তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করতেন।

 

নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। আয়শা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন -রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘর নিজেই পরিষ্কার করতেন। বকরীর দুধ দোহন করা সহ নিজের সব কাজ নিজেই করতেন। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জুতা ও কাপড় সাধারণ মানুষের মতো নিজেই সেলাই করতেন। (মুসনাদে আহমাদ: ২৫৩৮০) 

 

আরও পড়ুন: সামুদের ধ্বংসপ্রাপ্ত জায়গায় যে কারণে নবীজি যেতে নিষেধ করেছেন


শুধু নিজের কাজ করতেন না; বরং ঘরের কাজে স্ত্রীদের সাহায্যও করতেন। হাদিস শরীফে আছে , আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলো, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ির ভেতরে কী কী কাজ করতেন ?তিনি জবাব দিলেন ,

 

নবীজি স্ত্রীদের কাজে সাহায্য করতেন।এবং নামাজের সময় হলে উঠে চলে যেতেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে নবীজি তো একজন মানুষই ছিলেন ।তিনি নিজেই নিজের কাপড় সেলাই করতেন বকরীর দুধ দোহন করতেন ।এবং পুরুষরা ঘরে সচরাচর যেসব কাজ করে তিনি তা করতেন। (বুখারি, তিরমিজি)


 

আজকের সমাজে অনেক স্বামী মনে করেন, ঘরের কাজে সহায়তা করা তাদের মর্যাদার সাথে মানায় না। অথচ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আমরা দেখি এটি সম্মানেরই নিদর্শন।


দাম্পত্য সম্পর্ককে তিনি সবসময় সজীব রাখতেন। স্ত্রীদের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন, হাস্যরস করতেন,গল্প করতেন, একসাথে খাবার খেতেন। তিনি দেখিয়েছেন যে দাম্পত্য সম্পর্ক কেবল দায়িত্ব নয়, এটি ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও আনন্দের স্থান। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন -

 

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সঙ্গে একবার দৌড় প্রতিযোগিতা অবতীর্ণ হন ,এতে আমি তার থেকে অগ্রগামী হই ।পরবর্তী সময়ে আমি যখন মুটিয়ে যাই, তখন আবার দৌড় প্রতিযোগিতা হলে নবীজি এগিয়ে যান ।এবং বলেন আজকেরটা আগের বারের বদলা  (ইবনে হিব্বান: ৪৬৯১; আবু দাউদ: ২৫৭৮; ইবনে মাজাহ: ১৯৭৯) 


 

আরেকটি হাদিস শুনুন! একবার নবীজির স্ত্রীগণ নবীজির কাছে একত্রিত হল ,নবীজি এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেভাবে কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে। নবীজির কোনো এক স্ত্রী বর্ণনা করেন- সেটি ছিল খুরাফার ঘটনা। নবীজি বললেন তুমি খুরাফা সম্পর্কে জানো কি? তিনি বললেন, না। নবীজি বললেন, খুরাফা অজরা গোত্রের এক লোক। যাকে জাহিলি যুগে জিন নিয়ে গিয়েছিল ।সেখানে সে এক যুগ থেকে মানব সমাজে ফিরে এসে ,সেখানকার বিস্ময়কর কথাগুলো লোকদের বলে বেড়াতো। (তালখিসুল ইলাল: ৩২)

 

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের ভীষণ ভালোবাসতেন সুখে দুঃখে পাশে থাকতেন। কেউ দুঃখ পেলে তিনি তাকে সান্ত্বনা দিতেন। একদিনের ঘটনা ।কেউ মাফিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ইহুদির মেয়ে বলে খোঁচা দিলে তিনি বসে কাঁদছিলেন। নবীজি তাকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কাঁদছো কেন? তিনি বললেন আমাকে বলা হয়েছে আমি নাকি ইহুদীর মেয়ে‌। নবীজি বললেন -

 

মাফিয়া তোমার যে কপালওয়ালী নারী পৃথিবীতে তো দ্বিতীয়টি নেই ।তুমি একজন মহান নবীর মেয়ে। নবী নূহ আলাইহিস সালামের বংশধর। তোমার চাচা নবী হারুন আলাইহিস সালাম ।এবং তোমার স্বামী নবী ।তিন দিক থেকে নবীর সাথে সম্পর্ক আছে। এরকম নারী কে আছে দ্বিতীয়জন? তাই তারা ঈর্ষা করে তোমাকে ইহুদীর মেয়ে বলে।

 

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খাবার খেতেন। যদি খাবারে কোন ভুল থাকতো, তিনি তা ধরতেন না। যদি ভালো লাগতো খেতেন ।অন্যথায় রেখে দিতেন। (বুখারি: ২০৬৪; মুসলিম: ৫৪০৯)


আমাদের সমাজের কিছু ভদ্র মানুষ আছেন, যাদের খাবারে ভুল ধরা পেশায় পরিণত হয়ে গেছে। খেতে বসলে কোন না কোন ভুল, বের করেই ছাড়বেন।যেন সবসময় ভুল ধরার জন্যই অপেক্ষা করেন। এই হাদীস তাদের জন্য উজ্জল দৃষ্টান্ত হতে পারে।

 

আরও পড়ুন: অর্থ সঞ্চয়ের বিষয়ে ইসলাম কী বলে

 

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো স্ত্রীদের উপর হাত তোলেননি, গালি দেননি বা অবমাননাকর আচরণ করেননি। হাদিস শরীফে আছে-নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তার স্ত্রীদেরকে প্রহার করতেন না। (মুসলিম: ৫৯৪৪) আর যারা স্ত্রীদের প্রহার করে, তাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন- "তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীকে দাসীর মতো মারপিট না করে, সম্ভব দিনশেষে আবার তার শয্যা সঙ্গী হবে। (বুখারি: ৫২০৪) অন্য হাদীসে নবীজি বলেন, "তোমরা আল্লাহর দাসীদের প্রহার করো না। (আবু দাউদ: ২১৪৬)


বর্তমানে স্বামীদের মধ্যে রাগান্বিত হয়ে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা একটি বড় সমস্যা। নবীজির জীবন অনুসরণ করলে স্পষ্ট বুঝা যায়—জুলুমকারী ব্যক্তি কখনও উত্তম স্বামী হতে পারে না।

 

বর্তমান সমাজে অনেক স্বামী নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। বিশেষ করে—অনেক স্বামী ক্ষুদ্র বিষয়েও রাগ করেন, আত্মীয়দের সামনে অপমান করেন, কঠোর ভাষা ব্যবহার করেন। এবং এটাকে স্বাভাবিক মনে করে ।অথচ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সর্বদা কোমল ভাষায় কথা বলার শিক্ষা দিয়েছেন।


নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাম্পত্য জীবন আমাদের জন্য সর্বোচ্চ আদর্শ। তিনি দেখিয়েছেন, একজন স্বামীর প্রকৃত শক্তি তার রাগে নয়, বরং তার কোমলতা, দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসায়। 

 

আজকের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে আমরা যদি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাম্পত্য জীবনের আদর্শগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করি, তবে আমাদের দাম্পত্য জীবন হবে সুন্দর, সুশৃংখল ও অর্থবহ। পরিবারের বন্ধন দৃঢ় হবে ,শান্তি আসবে।এবং সমাজে সুখী পরিবার বাড়বে। আল্লাহ আমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের করুন এবং দাম্পত্য জীবনে নবীজির আদর্শ বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন। আমিন!

 

লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম রামপুরা (বনশ্রী মাদরাসা) ঢাকা 
 

 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন