স্থানীয় উন্নয়ন ও প্রকৃতি সংরক্ষণের সমন্বয়ে সুন্দরবনের টেকসই পর্যটনে ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান

২ সপ্তাহ আগে
বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও টেকসই পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে ২০ বছর মেয়াদি ‘সুন্দরবন ইকোট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান (২০২৫–২০৪৫)’। ইউএসএআইডির আর্থিক সহায়তা ও সোলিমার ইন্টারন্যাশনালের কারিগরি সহযোগিতায় বন বিভাগ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিকল্পনাটি প্রস্তুত করা হয়েছে।

সবুজ গাছ, খাল-বিল আর বন্যপ্রাণীর সমাহার—এ যেন প্রকৃতির এক জীবন্ত শিল্পকর্ম। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন মানেই শান্ত, সুনিবিড় এক আশ্রয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাস, সুন্দরী, গেওয়াসহ হাজারো প্রজাতির বনজ সম্পদের এই বন শুধু পর্যটন নয়, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষারও প্রাকৃতিক ঢাল। তবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান পর্যটক চাপের কারণে সুন্দরবনের ভারসাম্য এখন হুমকিতে।


একদিকে যাতায়াত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, প্রাথমিক চিকিৎসার অভাব, প্রশিক্ষিত গাইডের সংকট আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় বিপন্ন হচ্ছে বনের ভারসাম্য। যত্রতত্র পলিথিন ফেলা আর অপরিকল্পিত কটেজ স্থাপনেও বাড়ছে পরিবেশগত ঝুঁকি।


এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই প্রস্তুত করা হয়েছে ২০ বছর মেয়াদী সুন্দরবন ইকোট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান। ইউএসএআইডির অর্থায়নে বন বিভাগ ও সোলিমার ইন্টারন্যাশনালের কারিগরি সহায়তায় প্রণীত এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. ওয়াসিউল ইসলাম।


মাস্টারপ্ল্যানে গুরুত্ব পেয়েছে কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম মডেল, যাতে স্থানীয়দের বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমে বিকল্প জীবিকা গড়ে ওঠে। এছাড়া তথ্যকেন্দ্র স্থাপন, ইকো গাইড প্রশিক্ষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পর্যটক নিরাপত্তার দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে।


খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ওয়াসিউল ইসলাম তিনি জানান, প্রায় দুই বছরের গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এটি তৈরি হয়েছে। এতে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটক নিরাপত্তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটি সম্পৃক্ততা ও বিকল্প জীবিকা উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।


ড. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসবে। স্থানীয়রা সরাসরি ইকোট্যুরিজম কার্যক্রমে যুক্ত হবে, ফলে বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরতা কমে আসবে এবং জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম আরও টেকসই হবে।’

 

আরও পড়ুন: সুন্দরবনে অদ্ভুত বন্ধন / বন কর্মকর্তার সঙ্গে প্রতিদিন নাস্তা করে ঈগল


পরিকল্পনাটিতে রয়েছে ৬টি স্ট্র্যাটেজিক অবজেকটিভ, ৪১টি স্ট্র্যাটেজি ও ২০০টি অ্যাকশন পয়েন্ট; যা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী সময়সীমায় বাস্তবায়িত হবে। এর আওতায় গড়ে তোলা হবে ইকো-গাইড প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তথ্যকেন্দ্র, পর্যটক নিরাপত্তা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা। এরইমধ্যে ২০০ জনের বেশি স্থানীয় গাইডকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যারা দায়িত্বশীল পর্যটন পরিচালনায় ভূমিকা রাখবেন।


সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ পর্যটক সুন্দরবনে ঘুরতে আসেন। এ বিপুল সংখ্যক পর্যটককে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন এই মাস্টারপ্ল্যান দায়িত্বশীল ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন নিশ্চিত করবে। তিনি আরও জানান, পরিকল্পনাটি অনুমোদনের জন্য বর্তমানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। অনুমোদন মিললেই প্রথম ধাপে তিন বছর মেয়াদি বাস্তবায়ন শুরু হবে।


পর্যটন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবন-ভিত্তিক পর্যটন খুলনা অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন গতি আনবে। বিদেশি পর্যটক বাড়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও খুলবে।


স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা ও জীবিকার উন্নয়নকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনায়। দাকোপ, শরণখোলা ও মোংলা এলাকায় স্থাপিত ইকো-কটেজে কাজ করা স্থানীয়দের পর্যটক সেবা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রকৃতি সংরক্ষণ ও পর্যটন একসঙ্গে এগিয়ে যায়।


দুই দশকের এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবন শুধু পর্যটনের নয়, বরং প্রকৃতি সংরক্ষণ ও স্থানীয় উন্নয়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে—এমনটাই আশা সংশ্লিষ্টদের।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন