যেভাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে উঠলেন সুব্রত বাইন
সুব্রত বাইনের আদি নিবাস বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার জোবারপাড় গ্রামে। তার জন্ম ১৯৬৭ সালে। বাবা বিপুল বাইন একটি এনজিওর গাড়ি চালাতেন। মায়ের নাম কুমুলিনি বাইন। তিন বোন আর এক ভায়ের মধ্যে সুব্রত সবার বড়। তিন মেয়েকে নিয়ে সুব্রতর মা ঢাকার মগবাজারের ভাড়া বাসায় থাকতেন।
বরিশালে অক্সফোর্ড মিশন স্কুল নামে খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন সুব্রত। সেখানে হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরে তাকে ঢাকায় শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয় এবং সেখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দেন। এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সেখানকার এক নেতার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর কলেজে আর ভর্তি হওয়া হয়নি তার।
সুব্রত বাইন কথিত ‘সেভেন স্টার’ বাহিনীর প্রধান ছিলেন। পুলিশের খাতায় তাঁর পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন।
কিশোর বয়সে খুব অল্প দিনেই মগবাজার এলাকায় একটি সন্ত্রাসী চক্র গড়ে তোলেন সুব্রত। ১৯৯৩ সালের দিকে মধুবাজারে এক সবজিবিক্রেতা খুনের ঘটনায় পুলিশের তালিকায় তার নাম ওঠে। এর কিছুদিন পর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলি হয়। সেই থেকে সুব্রত বাইনের নাম গণমাধ্যমে আসতে থাকে। সুব্রত বাইন পরে বিশাল সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতাও হন।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় সুব্রত বাইন অপরাধ জগতে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।
১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডার, মগবাজারের রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ বেশ কয়েকজনের খুনের ঘটনায় নাম আসে সুব্রতর। ওই সময় রমনা, মগবাজার, কারওয়ান বাজার ও মধুবাগ এলাকায় প্রায়ই গোলাগুলির ঘটনা ঘটত। তার বিরুদ্ধে সে সময় কমপক্ষে ৩০টি মামলা ছিল। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে আগারগাঁওয়ে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মুরাদ খুনের ঘটনায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়।
আরও পড়ুন: শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন সহযোগীসহ গ্রেফতার
১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন সুব্রত বাইনকে গ্রেফতার করেন। দেড় বছরের মতো জেলে থাকার পর তিনি জামিনে বের হন। সুব্রত জেলে থাকার সময় তার স্ত্রী লুসি গ্রুপেরই এক সদস্যের প্রেমে পড়েন। জেল থেকে বেরিয়ে ঘটনা জানার পর সুব্রত নিজেই লুসিকে সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। লুসির ঘরে সুব্রতর দুই সন্তান ছিল। পরে ১৯৯৯ সালে কুমিল্লায় বিউটি নামের এক নারীকে বিয়ে করেন সুব্রত কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় বিউটিকে ডিভোর্স দেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। সেই তালিকায় প্রথম নামই ছিল সুব্রত বাইনের। তাকে ধরতে ইন্টারপোলেও নোটিশ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে সুব্রত ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় ঘাঁটি গাড়েন। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জামেলা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই ঘরে একটি মেয়ে আছে।
ভারতে গিয়ে জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নথিপত্র তৈরি করেন সুব্রত। এরপরও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশ তাকে আটক করে। তবে অল্প দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে দুবাই চলে যান। সেখান থেকে ফিরে কলকাতার এক চিত্রনায়িকার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। সেই ফোন কলের সূত্র ধরে ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স তাকে ধরার চেষ্টা করলে সুব্রত নেপালের সীমান্ত শহর কাঁকরভিটায় ঢুকে পড়েন। সেখানে নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। প্রথমে তাকে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর এবং পরে ঝুমকা কারাগারে নেওয়া হয়। ২০১২ সালে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে সেই কারাগার থেকে পালিয়ে যান। আবার কলকাতায় আসার কয়েক দিন পর ২৭ নভেম্বর বউবাজার এলাকা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতারর করে। এরপর থেকে তিনি কলকাতার জেলেই ছিলেন। সেখানে ফতেহ আলী নাম নিয়ে ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সহযোগী শুটার বিপু গ্রেফতার
কলকাতায় বসেই ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন সুব্রত বাইন। পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের পরিবার আগে থাকত রাজধানীর মগবাজারে। পরে তারা গাজীপুরের পুবাইল হারবাইদ নয়াপাড়ায় পাঁচ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেন। এখন সেখানেই থাকেন সুব্রত বাইনের বাবা বিপুল বাইন ও মা কুমুলিনি বাইন।
সুব্রত বাইন পলাতক অবস্থায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ২০০৪ সালে তিনি সর্বশেষ তার মা-বাবাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ভারতের কারাগারে থাকাকালীনও তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং একবার ফোনও করেছিলেন ।