সোনা বানুর ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সোনা বানু বলেন, কেন এমন করা হলো, সে বিষয়ে তাকে কিছুই বলা হয়নি। জীবনের অধিকাংশ সময় তার এবং তার পরিবারের আসামেই কেটেছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তাকে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হয়েছে যে, তিনি ভারতের নাগরিক, ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ নন।
চোখ মুছতে মুছতে এই নারী বলেন, ‘আমাকে বন্দুক ঠেকিয়ে তারা সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়। দুই দিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে হাঁটুপানি ডোবা একটা মাঠে আমাকে কাটাতে হয়েছে। ওই জায়গাটা মশা আর জোঁকে ভর্তি।’
সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ দুই দিন থাকার পর তাকে বাংলাদেশ অংশে একটি পুরনো কারাগারের মতো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাটে আরও দুই দিন। পরে তাকে এবং আরও কয়েকজনকে সীমান্তে নিয়ে যান বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। সেখানে ভারতীয় কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের দেখা হয়। পরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে আবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
বিবিসি বলছে, ঠিক কী কারণে সোনা বানুকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে আবার ফিরিয়ে নেয়া হলো তা স্পষ্ট নয়। তবে গত কিছুদিনে আসামে এরকম আরও ঘটনা ঘটেছে। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ‘বিদেশি’ ঘোষিত ব্যক্তিদের ধরে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
বিবিসি সোনা বানুর মত অন্তত ছয়জনের সঙ্গে কথা বলেছে, যাদের পরিবার এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী, আসাম পুলিশ বা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: দিনাজপুর সীমান্তে পুশইন ও গরু চোরাচালান রোধে সতর্ক বিজিবি
ভারতে বৈধ কাগজপত্রহীন বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান নতুন নয়। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে ৪০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক জটিল সীমান্ত, যার বেশ কিছু অংশ খোলা এবং অনিয়ন্ত্রিত। অনেক জায়গা দিয়েই অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার তুলনামূলকভাবে সহজ।
মানবাধিকার আইনজীবীরা বলছেন, কাউকে বাড়ি থেকে ধরে এনে বিচার ছাড়াই অন্য দেশে পাঠিয়ে দেয়ার এমন ঘটনা আগে ‘বিরল’ হলেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে।
এই অভিযানে কতজনকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি ভারত সরকার। তবে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বরাতে বিবিসি বলছে, মে মাসেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে অন্তত ১২০০ জনকে ‘অবৈধভাবে ঠেলে পাঠানো হয়েছে’, যাদের মধ্যে ১০০ জনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করে বাংলাদেশ ফেরত পাঠায়।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ জানিয়েছে, তারা সীমান্তে টহল জোরদার করেছে। বিবিসি বলছে, অবৈধ বাংলাদেশি বলে অনেক রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে ভারত।
তবে আসামের পরিস্থিতি আরও জটিল। জাতীয়তা ও অভিবাসনের বিষয়টি বহু বছর ধরেই স্থানীয় রাজনীতিতে আলোচিত একটি বিষয়। ভারতের এ রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এবং ঐতিহাসিকভাবেই ওই সীমান্ত অভিবাসনের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
স্থানীয় আসামিদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে এই অভিবাসনের ফলে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি এবং সম্পদের ওপর চাপ পড়ছে।

ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির, যারা এখন আসামসহ কেন্দ্রীয় সরকারেও ক্ষমতায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে ‘অবৈধ অভিবাসন’ ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। এর অংশ হিসেবে আসামে চালু করা হয়েছে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রক্রিয়া।
ওই নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যারা বাদ পড়েছেন, তাদের ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে আসামে বসবাসের প্রমাণ দিতে বলা হয়। প্রমাণ না থাকলে ট্রাইব্যুনালে শুনানির সুযোগ দেয়া হয়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় বাদ পড়েন প্রায় ২০ লাখ মানুষ, যাদের কেউ কেউ এখনো বন্দি শিবিরে আছেন, আর কেউ কেউ উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।
সোনা বানুর দাবি, তার মামলাও ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। তবু তাকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। সোনা বানুর মতো আসামের আরও ছয়জনের ঘটনা উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে, তারা সবাই মুসলমান, তাদের মধ্যে অন্তত চারজন আবার আসামে পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছেন।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে ফেরত ও পুশইন বন্ধে যে বার্তা দিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
এই পরিবারগুলোর ভাষ্য, সব বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও এবং বহু বছর ধরে আসামে থাকার পরও তাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। কেন তাদের সঙ্গে এমন করা হলো, তা তারা জানেন না।
আসামের ৩ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মুসলমান। তাদের অনেকের পূর্বপুরুষ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আসামে বসবাস করে আসছেন। যাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন ৬৭ বছর বয়সি মালেকা খাতুন। আসামের বারপেটায় তার বাড়ি।
ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে মামলা হারার পর হাইকোর্টে গিয়েছিলেন মালেকা, তাতে লাভ হয়নি। এরপর আর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেননি তিনি। বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পর আপাতত স্থানীয় এক পরিবারে আশ্রয় পেয়েছেন মালেকা তিনি বলেন, ‘এখানে আমার কেউ নেই।’
পরিবারের সদস্যরা আসাম থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলেও তারা জানেন না, মালেকা আবার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন কি না। এভাবে দলে দলে মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া শুরুর পর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গত ফেব্রুয়ারিতে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশনার কথা তোলেন।
তিনি বলেন, যারা ‘ভারতের বৈধ নাগরিক নয়’ বলে প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু এখনো যাদের বন্দিশালায় রাখা হয়েছে, তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠাতে বলেছে আদালত।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা আরও বলেন, ‘যারা ভিনদেশি ঘোষিত হয়েছে, এখনো আপিল করেনি, তাদের আমরা ফেরত পাঠাচ্ছি। যাদের আপিল নিষ্পত্তি হয়েনি, তাদের কোনো সমস্যা হবে না।’
এ ধরনের অনেক মামলায় আইনি সহায়তা দেয়া আব্দুর রাজ্জাক ভূইয়া বিবিসিকে বলেন, আদালতের ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গেলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা, তা করা হচ্ছে না। তার মতে, এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতে আদেশের ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে।
এই ‘অবৈধ পুশ ব্যাক নীতি’ বন্ধে আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছিলেন রাজ্জাক। কিন্তু তাদের প্রথমে আসাম হাইকোর্টে আবেদন করতে বলা হয়েছে।
]]>