সুপেয় পানির জন্য এত কষ্ট হাজাপাড়াবাসীর!

৯ ঘন্টা আগে
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার গুমতি ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের নাম হাজাপাড়া। সবদিক থেকেই যেন উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত এই গ্রামটি। নেই যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা, নেই কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র, নেই শিক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। তবে এ গ্রামের মানুষের সবচেয়ে বড় দৈনন্দিন সংকট- সুপেয় পানির অভাব।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে হাজাপাড়ায় পৌঁছাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পায়ে হেঁটে চলতে হয়। রাস্তা নেই, ব্রিজ নেই, গাড়ির চলাচল অসম্ভব। বর্ষাকালে এই পথ আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য এ গ্রামের মানুষকে প্রাথমিকভাবে দেড় ঘণ্টা হাঁটতে হয়, তারপর কোনো বাহন পেলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়া যায়। অনেক রোগী, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও বয়স্করা সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারাও যান।


গ্রামের বাসিন্দা কুলেন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা সুপেয় পানির জন্য রোজ এক ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে নিচে নামি, আবার পানি মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসি। এই কাজটা আমাদের শিশুদেরও করতে হয়। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে, পড়ালেখা ছেড়ে দেয়।’


অনিল ত্রিপুরা, প্রতিভা ত্রিপুরাসহ আরও অনেকে জানান, তাদের গ্রামে একটি টিউবওয়েল পর্যন্ত নেই। বৃষ্টি নির্ভর কুয়া, ছড়া, গিরি, ঝিরি আর নালা- এসব প্রাকৃতিক জলাধারই তাদের একমাত্র ভরসা।


তবে এই পানিও যে সবসময় পাওয়া যায়, তেমনটা নয়। শুকনো মৌসুমে এসব জলাশয় প্রায় শুকিয়ে যায়। আর বর্ষার সময় পাহাড়ি পানিতে ময়লা-আবর্জনা মিশে তা পান করার অযোগ্য হয়ে পড়ে। ফলে সারা বছরই পানির সংকট চলতে থাকে।


আরও পড়ুন: সরু ও আঁকাবাঁকা খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সড়ক, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি


স্থানীয় ইউপি সদস্য উজ্জল কান্তি ত্রিপুরা জানান, 'শুষ্ক মৌসুমে হাজাপাড়া ও আশপাশের গ্রামে পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। পানির জন্য যেন একেকটা যুদ্ধ করতে হয়। বারবার বলেছি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে, কিন্তু দৃশ্যমান কোন কাজ এখনও হয়নি।'


হাজাপাড়া গ্রামের সন্তান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকপ্রাপ্ত ভাষা গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, 'এই গ্রামটা যেন আধুনিক বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এক টুকরো কষ্টের নাম। আজও রিংওয়েল, টিউবওয়েলের সুবিধা পৌঁছায়নি। উন্নয়নের মূল সূচকগুলোর একটাও এখানে কার্যকর নয়- না পানি, না চিকিৎসা, না শিক্ষা, না যোগাযোগ। বিশেষ করে পানির সমস্যা এখন এমন এক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, এটি শুধু একটি সমস্যা নয়, একটি মানবিক বিপর্যয়।'


এলাকাবাসীর অভিযোগ, শুধু হাজাপাড়া নয়, জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। কিন্তু বাস্তবে তার সমাধানে কাজ হচ্ছে না বললেই চলে।


এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের খাগড়াছড়ি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাশের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।


খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, 'পার্বত্য অঞ্চলে সুপেয় পানির সমস্যা একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। বর্ষাকালে কিছু পানির উৎস থাকে, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে তা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা মাটিরাঙ্গা উপজেলার হাজাপাড়া গ্রামটিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করছি এবং পরিকল্পনার মধ্যে নিয়েছি।'


তবে স্থানীয়রা বলছেন, পরিকল্পনা বহুবার হয়েছে, বাস্তবায়ন হয়নি। তারা চান, অবিলম্বে টেকসই সমাধান- যেমন গভীর নলকূপ, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ব্যবস্থা বা সৌরচালিত পানির পাম্প স্থাপন করা হোক।


পাহাড়ের এই মানুষরা আকুল আবেদন করে বলেন, 'আমরা আর চাই না প্রতিদিন পানি আনতে পাহাড়ে নামতে। আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা হোক, মায়েদের কষ্ট কমুক। শুধু একটু সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দিন।'


আরও পড়ুন: তরুণদের সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে খাগড়াছড়ির কৃষিভিত্তিক ইকো-ট্যুরিজম


বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ পার্বত্য এলাকার জন্য টেকসই সমাধান হিসেবে 'রেইনওয়াটার হারভেস্টিং' একটি উপযুক্ত পন্থা হতে পারে। প্রতিটি বাড়িতে বা কমিউনিটি পর্যায়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকলে অনেকটাই সুপেয় পানির ঘাটতি পূরণ সম্ভব। এছাড়া সৌরচালিত পানির পাম্প বসিয়ে পাহাড়ের নিচ থেকে পানির উত্তোলন করে গ্রামে সরবরাহ করা যেতে পারে।


সচেতন ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠকরা বলছেন, হাজাপাড়ার মানুষদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা শুধু একটি নাগরিক অধিকার নয়, এটি মানবিকতা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো যদি আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসে, তবে হাজাপাড়ার মানুষও পাবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপায় 'এক চুমুক বিশুদ্ধ পানি'।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন