জানা যায়, নীলফামারীর জেলাসহ উত্তরের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ। ২০১১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রতিশ্রুতি দেন এবং ২০২০ সালে বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রকল্পে ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন, তিনটি গ্যাস স্টেশন নির্মাণ এবং বিভিন্ন নদী-খাল ক্রসিংসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। মোট ব্যয় ছিল ১৪৭০ কোটি টাকা, যা আগে নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি।
২০২৩ সালের শেষে গ্যাস সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, জেলার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও গ্যাস সংযোগ পাননি। কিন্তু সিটিগেট গ্যাস সঞ্চালন কেন্দ্র ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস সরবরাহ লিমিটেডের (পিজিসিএল) আওতাধীন সৈয়দপুর সরবরাহ কেন্দ্রে পর্যাপ্ত গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) ইতোমধ্যে রেগুলেটিং ও মিটারিংয়ের কাজ শেষ করেছে। একইভাবে পিজিসিএল সরবরাহ কেন্দ্রের ডিআরএস তৈরির কাজও সম্পন্ন হয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, কেন্দ্র দুটি প্রধান ফটক বন্ধ রেখে নিরাপত্তা প্রহরীর হেফাজতে পড়ে আছে। সেখানে নেই কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নেই কোনো কার্যক্রম।
সূত্রে জানা গেছে, সৈয়দপুর সিটিগেট স্টেশন ও সরবরাহ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। এরইমধ্যে ইপিজেড ও বিসিক শিল্প নগরীর পাইপলাইন বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ অবকাঠামোগত কোনো ঘাটতি নেই।
আরও পড়ুন: বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ দামে প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানি তেলে কমলো ৪ শতাংশ
সংশ্লিষ্ট স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, আমরা বাইরের উৎস থেকে গ্যাস কিনে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছি। সবকিছু প্রস্তুত থাকলেও কেনো সংযোগ দেয়া হচ্ছে না, আমরা বুঝতে পারছি না। গ্যাস সংযোগ না থাকায় উত্তরা ইপিজেড, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা, বিসিক শিল্প নগরীসহ বিভিন্ন ভারী ও মাঝারি শিল্প কারখানাকে বাইরে থেকে উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে। এতে আমাদের খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। গ্যাস সরবরাহ না হওয়ায় জেলার শিল্পখাতে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। ফলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আংশিক উৎপাদন চালাচ্ছে, কেউ কেউ আবার বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, আমরা প্রতিদিন বাইরে থেকে গ্যাস কিনে আনি। এতে উৎপাদন ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। অথচ যদি সরাসরি সংযোগ দেয়া হতো, খরচ অর্ধেকে নেমে আসত। দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্যাস সংযোগ না দেয়া হলে শিল্পাঞ্চল হিসেবে নীলফামারীর অগ্রযাত্রা থমকে যাবে। এরইমধ্যে সম্ভাব্য অনেক বিনিয়োগকারী তাদের প্রকল্প স্থগিত রেখেছেন।
নতুন শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, আমরা ভেবেছিলাম, খুব শিগগিরই গ্যাস পাব। কিন্তু দুই বছর পার হয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ নেই। আমরা বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনছি। এতে আমরা শুধু লোকসান গুনছি। এভাবে চলতে থাকলে নতুন কোনো বিনিয়োগকারী এখানে আসবে না। বিদ্যমান কারখানাগুলোও টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
রয়েল রিলাক্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক রাজু পোদ্দার বলেন, ‘কেবল আশ্বাস দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। বাস্তবে গ্যাস সরবরাহ শুরু না হলে জেলার শিল্পখাত ক্ষতির মুখেই থাকবে।’
আরও পড়ুন: বৃহস্পতিবার থেকে চালু নীলফামারী ইপিজেডের সব কারখানা
রানু এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুশান্ত কুমার বলেন, ‘গ্যাস সংযোগ পেলে উৎপাদন ব্যয় কমবে, নতুন কারখানা গড়ে উঠবে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং জেলার সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ না হওয়ায় সেই সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হচ্ছে। অবিলম্বে গ্যাস সরবরাহ না হলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন দুটোই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উত্তর জনপদের শিল্পোন্নয়ন ও নীলফামারীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতে হলে এখন একটাই দাবি দ্রুত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা।’
বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ‘বিসিকের সামনে পর্যন্ত পাইপলাইন বসানো হয়েছে। আমরা একাধিকবার পিজিসিএলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। সংযোগ না থাকায় উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
জেলা প্রশাসক মো. নায়েরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আশাবাদী, খুব শিগগিরই সংযোগ দেয়া হবে। এরইমধ্যে পিজিসিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে।’