শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যখন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বক্তব্য রাখছিলেন, ঠিক তার পেছনেই বসা ছিলেন সামসি আরা জামান। এ সময় ক্যামেরায় ধরা পড়ে ক্ষণে ক্ষণে ছেলেকে স্মরণ করে তার চোখ মোছার দৃশ্য।
২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কাভার করার সময় ১৯ জুলাই ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডে ল্যাবএইড হাসপাতালের পেছনে বিকেল ৫টায় পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে প্রিয় শহীদ হন। দেশজুড়ে তখন কারফিউ চলছে।
সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছেলের সেই আত্মত্যাগের সম্মাননা পান সামসি আরা জামান। কিন্তু তার চোখ ছিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকদের দিকেই। যেন বারবার খুঁজছিলেন অতি পরিচিত একটি মুখ। যে মুখের জন্য হাজারো কষ্ট সয়েছেন, সেই নাড়ি ছেঁড়া ধনকে তিনি খুঁজছিলেন শত সাংবাদিকের ভিড়ে।
অনলাইন পোর্টাল দ্য রিপোর্ট ডটলাইভের ভিডিও জার্নালিস্ট ছিলেন তাহির জামান প্রিয়।
আরও পড়ুন: এরপর দেশের জন্য হাত লাগলে তরুণদের ১০০ বার ভাবতে হবে, অনলাইনে সমালোচনা
১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে প্রিয়র প্রাণ হারানোর ঘটনা গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী তানভীর আরাফাত ধ্রুব।
ঘটনার স্মৃতিচারণ করে ধ্রুব বলেন, শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়কে আমি চিনতাম না। কিন্তু এ ঘটনা আমার সামনেই ঘটেছে। সেদিন বিকেলে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রাণঘাতি বুলেট ছুড়তে থাকে পুলিশ। ছাত্র-জনতা কিছু বুঝে উঠার আগেই পুলিশের ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি দল দ্রুত পিছন দিক থেকে গ্রিনরোডের মুখে চলে আসে। এ সময় শুনি তাহির জামান এক মেয়েকে [সৈয়দা ফারিয়া উলফাৎ] বলছিল, ‘যাই হোক আমরা কিন্তু একসাথে থাকবো।’ সবাই পুলিশ বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ে যান এবং আন্দোলনকারীদের অনেকে হঠাৎ প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান। তখন আমি সেন্ট্রাল রোড ও গ্রিনরোডের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ সময় দেখি পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনীর ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনরত ২৫-৩০ জন ছাত্র সায়েন্সল্যাবের দিক থেকে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজমুখী সেন্ট্রাল রোডের ভেতরে ঢুকে অবস্থান নেয়।
জুলাই আন্দোলনে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়। ছবি সংগৃহীত
তিনি আরও বলেন, পুলিশের একটি দল সায়েন্স ল্যাবের দিক থেকে এবং অপর একটি পুলিশের দল ল্যাব এইডের দুই ভবনের মাঝের রাস্তা ধরে ওয়াই শেইপে সেন্ট্রাল রোডের অভিমুখে একসাথে এগিয়ে যেতে থাকেন। পরক্ষণে দেখা যায় পুলিশের পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা মুর্হুমুর্হু গুলি ছুড়তে থাকে। আনুমানিক বিকেল ৫টা ৫ মিনিটের দিকে আমি গুলির শব্দ শুনতে পাই। আত্মরক্ষার জন্য আমি ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ১০-১২ ফুট দূরে কমলা রঙয়ের শার্ট ও কালচে রঙয়ের প্যান্ট পরিহিত একজনের [তাহির জামান] নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখি। তার মাথার পেছন থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে দেখি। এ সময় অজ্ঞাতনামা ৪-৬ জন আন্দোলনকারীদের একজন একটি সাদা টিশার্ট উঁচিয়ে তাহির জামান প্রিয়র দেহ টেনে সেন্ট্রাল রোডে আনার চেষ্টা করে। গুলিবিদ্ধ দেহটি ল্যাবএইড হাসপাতালে নেয়ারও চেষ্টা চালান তারা। কিন্তু তখন পুলিশরা অনবরত গুলি ছুড়তে থাকে। আন্দোলনরত ছাত্ররা তাহিরের দেহ ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। এ সময় উপস্থিত সেই আন্দোলনকারীরা সবাই প্রাণভয়ে সেন্ট্রাল রোডের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
আরও পড়ুন: গণমাধ্যমের পেশাদারিত্বের ঘাটতি ভীষণভাবে ব্যথিত করে: ফয়েজ আহম্মদ
পরে রাত ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে উদ্ধার হয় তার নিথর দেহ।
সন্তানের মৃত্যুর পর সামসি আরা জামান গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, মা ও মেয়েকে খুব ভালোবাসতেন প্রিয়। কথা দিয়েছিলেন মা এবং মেয়ে পদ্মপ্রিয় পারমিতাকে একটি সুন্দর জীবন দেবেন। কিন্তু স্বপ্নবাজ প্রিয়র মৃত্যুর পর তার স্বপ্নগুলোও এখন মৃত। ৫ বছর বয়সী মেয়ে এখনও বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। অপেক্ষায় থাকে বাবার হাত ধরে বেড়ানোর। কিন্তু প্রিয়র আর ফেরা হয় না।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের তথ্যমতে—গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে শহীদ হয়েছেন ৬১ জন সাংবাদিক। ২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলনে’ প্রাণ হারিয়েছেন ৬ জন। তাদের একজন তাহির জামান প্রিয়।
]]>
১ সপ্তাহে আগে
৬








Bengali (BD) ·
English (US) ·