সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রাষ ঘোষণা করেন। হাসিনার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে মৃত্যুদণ্ড এবং দুটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়।
আর রাজসাক্ষী হয়ে সত্য সামনে আনতে সহায়তা করায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এদিকে রায়ের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফেরত পাঠাতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
তবে এ নিয়ে ভারত যে বার্তা দিয়েছে তাতে দণ্ডপ্রাপ্তদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি। ভারত জানিয়েছে, ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে, ভারত বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতা।
দণ্ডপ্রাপ্তদের ফেরত চেয়ে ঢাকার বিজ্ঞপ্তি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফেরত চেয়ে দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আজকের রায়ে পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল জুলাই হত্যাকাণ্ডের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত এবং দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত এই ব্যক্তিদের দ্বিতীয় কোনো দেশ আশ্রয় দিলে তা হবে অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞার শামিল।
ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, আমরা ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন অবিলম্বে দণ্ডপ্রাপ্ত এই দুই ব্যক্তিকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান প্রত্যার্পণ চুক্তি অনুসারে এটি ভারতের জন্য অবশ্য পালনীয় দায়িত্বও বটে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
পরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার জন্য ভারতকে অবশ্যই চিঠি পাঠাবে ঢাকা। আজ রাতে বা আগামীকাল (মঙ্গলবার) সকালে ভারতে অবশ্যই চিঠি যাবে।’
শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়ে ভারতের বার্তা
শেখ হাসিনার রায়ের বিষয়ে ভারত অবগত আছে জানিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক বার্তা দিয়েছে দিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এছাড়া সন্ধ্যায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সামাজিক মাধ্যম এক্সে বিবৃতিটি প্রকাশ করেন।
আরও পড়ুন: ফাঁসির রায় / আপিল করতে পারবেন কি হাসিনা ও কামাল?
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ঘোষিত রায় সম্পর্কে ভারত অবগত হয়েছে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে, ভারত বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সেই লক্ষ্যে আমরা সর্বদা সব অংশীদারদের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে জড়িত থাকব।’
এদিকে বার্তায় ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনার রায়ের বিষয়টি অবহিত আছে জানালেও তাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি পরিষ্কার না করায়, এ নিয়ে একটি ধোঁয়াশা রয়েই গেল।
যে চুক্তির বলে শেখ হাসিনাকে ফেরত চায় বাংলাদেশ
২০১৩ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। দেশটির কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা।
ভারতের দৈনিক আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে সেই চুক্তির বিষয়ে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী আদালতের রায়ে প্রত্যর্পণ করানোর মতো অপরাধ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এক দেশ অপর দেশের হাতে তুলে দেবে। এই বিষয়ে সবিস্তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল, ন্যূনতম এক বছরের জেল হতে পারে, এমন অপরাধ করে থাকলে সেই ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা হবে। এও বলা হয়েছিল যে, সেই অপরাধকে চুক্তি স্বাক্ষর করা দুই দেশেই শাস্তিযোগ্য হতে হবে।
আরও পড়ুন: ভারতে অবশ্যই চিঠি যাবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
অপরাধে প্ররোচনা দেয়া বা সাহায্য করা ব্যক্তিকেও প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।
২০১৬ সালে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করতে চুক্তি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত চুক্তিতে বলা হয়, কারও নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেই তাকে প্রত্যর্পণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের প্রমাণস্বরূপ কোনো তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে হবে না। হাসিনার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। সংশোধিত চুক্তি অনুসারেই তাকে প্রত্যর্পণ করার কথা বলেছিল অন্তর্বর্তী সরকার।
এ চুক্তির বলেই ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেই হাসিনাকে ফেরত চেয়ে নয়াদিল্লিকে ‘কূটনৈতিক চিঠি’ (ভার্বাল নোট) অন্তর্বর্তী সরকার। ওই চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারও করেছিল ভারত। তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছিলেন, হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে বাংলাদেশের একটি চিঠি তারা পেয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য এখনই করা যাবে না।
পরে চলতি বছর অক্টোবর মাসে হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী জানান, এটির সঙ্গে আইনি বিষয় জড়িয়ে আছে। উভয় দেশের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কারণ এটি একটি বিচার বিভাগীয় এবং আইনি প্রক্রিয়া। এর জন্য দু’দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা এবং পরামর্শের প্রয়োজন।
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ চলাকালে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশের চিঠির কোনো উত্তর না দিলেও রায়ের পর ভারতের ওপর চাপ বেড়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
আরও পড়ুন: ‘হাসিনাকে হস্তান্তর করবে না ভারত’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে,বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন হাসিনার জন্য আরেকটি প্রত্যর্পণের অনুরোধ জারি করবে। ঢাকার এ সংক্রান্ত পূর্ববর্তী দাবিগুলোর প্রতি ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়া দেয়নি। তবে দুই দেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে।
বিবিসি আরও বলছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এছাড়া হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানোর বিষয়ে ভারতে রাজনৈতিক ঐকমত্যও রয়েছে। আর দিল্লির জন্য, বাংলাদেশ কেবল একটি প্রতিবেশী দেশ নয় - এটি কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতের সীমান্ত সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে প্রয়োজন ভারতের।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ বিষয়ে ভারত এক জটিল পরিস্থিতির মুখেই পড়েছে। কারণ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানানোকে ‘কূটনৈতিক অবজ্ঞা’ হিসেবে দেখা হতে পারে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তুলবে।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘিরে সারা দিন যা যা ঘটল
ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশীয় স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছেন, হাসিনার বিরুদ্ধে আদালতের রায় প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু ভারত পলাতক সাবেক বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীকে হস্তান্তর করবে না।
শ্রীরাধা দত্তের মতে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা একমত যে বাংলাদেশে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম দেশের আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ করে পরিচালিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দেশটির পরিস্থিতি দেখেছে সবাই। সবার আশা ছিল, তার (শেখ হাসিনা) বেশ কঠোর বিচার হবে।’
জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘নিরস্ত্র ছাত্রদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে কারও সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন) যে সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারও প্রমাণ আছে।’
‘আওয়ামী লীগ একটি পাল্টা ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু বাংলাদেশিদের বিশ্বাস, হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন’, যোগ করেন তিনি।
তবে মানবতাবিরোধী রায়ের পর ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং জার্মান ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজের সহযোগী ইশরাত হোসেন।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, এই রায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফেরাতে বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে।
]]>
১ সপ্তাহে আগে
৪






Bengali (BD) ·
English (US) ·