আগামী ৬ অক্টোবর লাদাখের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের। তার আগে বুধবার লেহ শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। অভিযোগ উঠেছে, বিজেপির পার্টি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। শুধু তা-ই নয়, পার্টি অফিসের সামনে থাকা পুলিশের গাড়িতেও আগুন লাগানো হয়। তারপরই পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশ এবং নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বিক্ষোভকারীরা।
পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ, লাঠিচার্জও করা হয়। বুধবারের বিক্ষোভ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন লাদাখের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদার দাবি নিয়ে চলা আন্দোলনের অন্যতম মুখ সোনম ওয়াংচুক।
ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক তথা শিক্ষা সংস্কারক সোনমের মতে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হেরে গেছে সহিংসতার কাছে। তবে তিনি এ-ও জানান, লাদাখের রাজনৈতিক দলগুলো অযোগ্য। তারা তরুণ প্রজন্মকে সঠিক দিশা দেখাতে ব্যর্থ। ওয়াংচুকের কথায়, এটি দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা আগুনেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে তিনি স্পষ্ট জানান, কোনো সহিংস আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করেন না।
যদিও লাদাখের অশান্ত পরিস্থিতির জন্য সোনমকেই দায়ী করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, তার ‘উস্কানিমূলক’ মন্তব্যের জন্যই লাদাখ অশান্ত হয়েছে। ‘স্টুডেন্ট্স এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ’-এর প্রতিষ্ঠাতা তথা সমাজকর্মী সোনমকে বিঁধে কেন্দ্রের দাবি, বার বার আবেদন করা সত্ত্বেও একাধিক নেতার অনশন প্রত্যাহার না করা এবং ‘আরব বসন্ত’, নেপালের ‘জেন জি’ প্রসঙ্গ তুলে লাদাখের জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: লাদাখে নিরাপত্তা বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে ৪ জন নিহত
বিবৃতিতে বলা হয়, সোনমের বক্তব্যে ‘উদ্বুদ্ধ’ হয়েই জনতার একটি অংশ অনশনস্থল ছেড়ে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ও সরকারি দফতরে হামলা চালায়। সরকার সূত্রে দাবি, অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে।
কে এই সোনম? কীভাবে লাদাখে আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠলেন তিনি?
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, তবে সার্বিকভাবে একজন শিক্ষাবিদ এবং সমাজকর্মী সোনমের কথা দেশের মানুষ জানতে পারেন মূলত ২০০৯ সালে ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর। আমির খান অভিনীত চরিত্র রণছোড়দাস শ্যামলদাস চাঁচড় ওরফে ‘র্যাঞ্চো’ চরিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল সোনমের জীবন-কাহিনির আদলে।
১৯৬৬ সালে লাদাখের লেহ’র আলচির কাছে জন্ম সোনমের। ৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কোনো স্কুলে ভর্তি হননি। কারণ, তার গ্রামে কোনো স্কুলই ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন মায়ের কাছে। ৯ বছর বয়সে সোনমকে শ্রীনগরে নিয়ে যাওয়া হয়, ভর্তি করা হয় সেখানকার একটি স্কুলে। যেহেতু তাকে দেখতে অন্য ছাত্রদের তুলনায় আলাদা ছিল, তাই তার সঙ্গে বিশেষ কেউ কথা বলত না। সোনমের মতে, সেই সময়টা তার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়।
১৯৭৭ সালে একাই দিল্লি পালিয়ে যান সোনম। সেখানে তিনি বিশেষ কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের স্কুলের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করেন। ওই অধ্যক্ষের সাহায্যে নতুন করে স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ওয়াংচুক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৮৭ সালে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি শ্রীনগর’ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোন শাখায় পড়াশোনা করবেন, তা নিয়ে বাবার সঙ্গে মতবিরোধের কারণে পড়াশোনার খরচ সোনমকেই বহন করতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন: লাদাখের ভূখণ্ড নিয়ে নতুন দুই অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা চীনের, ভারতের তীব্র প্রতিবাদ
স্নাতক হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে ভাই এবং পাঁচ সহকর্মীর সঙ্গে ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ (এসইসিএমওএল)’ নামে একটি সংস্থা শুরু করেন সোনম। সাসপোলের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুল সংস্কার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর, এসইসিএমওএল সরকারি শিক্ষা বিভাগ এবং গ্রামের জনগণের সহযোগিতায় ‘অপারেশন নিউ হোপ’ শুরু করেন।
১৯৯৩ সালে লাদাখের একমাত্র ছাপা পত্রিকা ‘লাদাগ্স মেলং’ প্রকাশ করেন সোনম। ২০০৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। ২০০১ সালে পার্বত্য পরিষদ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি।
২০০২ সালে লাদাখের অলাভজনক সংস্থাগুলোর সঙ্গে একযোগে ‘লাদাখ ভলান্টারি নেটওয়ার্ক’ প্রতিষ্ঠা করেন সোনম। ২০০৫ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির নির্বাহী কমিটিতে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লাদাখ পার্বত্য পরিষদের ‘লাদাখ ২০২৫’ শীর্ষক নথির খসড়া কমিটিতেও নিযুক্ত হন তিনি। ২০০৪ সালে লাদাখের শিক্ষা এবং পর্যটন নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব পান সোনম।
২০০৫ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আমলে ওয়াংচুক ভারত সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা সংস্কারের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সাহায্য করার কাজে যুক্ত একটি সংস্থার উপদেষ্টা হন তিনি।
এরপর, ২০১১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্সের গ্রেনোবলের ‘ক্র্যাটের স্কুল অফ আর্কিটেকচার’-এ ভর্তি হন সোনম। সেখানে দু’বছর পড়াশোনা করে দেশে ফেরেন। ২০১৬ সালে সোনম ‘ফার্মস্টেস লাদাখ’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে পর্যটকদের লাদাখের স্থানীয় পরিবারের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থাও করা হয়। ২০১৩ সালের শেষের দিকে কৃত্রিম বরফস্তূপের একটি নমুনা তৈরি করেন সোনম। ওই কৃত্রিম বরফের স্তূপ আসলে একটি কৃত্রিম হিমবাহ। শীতকালে নদীর জল বিশাল বরফস্তূপের আকারে সংরক্ষণ করে তা বসন্তের শেষ দিকে বরফ গলার সময় ছেড়ে দেয়া হয়।
২০১৩ সালে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য স্কুল শিক্ষা বোর্ডে নিযুক্ত করা হয় সোনমকে। ২০১৪ সালে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য শিক্ষানীতি তৈরির জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলেও যুক্ত করা হয় তাকে। ২০১৫ সাল থেকে সোনম বরফে মোড়া হিমালয়ের কোলে ‘হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অব অলটারনেটিভস’ নামে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার কাজে হাত দেন। উদ্দেশ্য, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা নয়, হাতে-কলমে ছাত্রদের জীবনধারণের পাঠ শেখানো। ২০১৮ সালে তার সেই প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: ট্রেন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ভারত!
কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি ছাড়াও লাদাখ, সিকিম এবং নেপালের মতো পাহাড়ি অঞ্চলে সৌরশক্তিচালিত বাড়ির নকশা এবং তত্ত্বাবধানেও সোনম সহায়তা করে আসছেন দীর্ঘ দিন ধরে। সোনমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও সৌরশক্তিচালিত। লাদাখ অঞ্চলে শীতকালে যখন তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নীচে নেমে যায়, তখনও তার স্কুল শিক্ষার্থীদের মনোরম পরিবেশ প্রদান করে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য সৌরশক্তিচালিত তাঁবু তৈরি করেন সোনম। প্রতিটি তাঁবুতে ১০ জনের মতো সৈন্য থাকতে পারেন। শিক্ষা এবং সমাজ সংস্কারমূলক কাজের জন্য দেশ-বিদেশে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। লাদাখে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য ২০১৮-তে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারও পান তিনি।
২০১৯ সাল থেকে নতুন লড়াই শুরু করেন সোনম। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে লাদাখের জন্য বেশ কিছু দাবি পেশ করেন। ২০২৩ সালে লাদাখের প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঁচানোর দাবিতে সরব হন। কেন্দ্রীয় সরকার সেই দাবি না মানায় অনশনও শুরু করেছিলেন। পাথর এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য নির্বিচারে ডিনামাইট দিয়ে লাদাখে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন সোনম। পাশাপাশি, জনজাতি অধ্যুষিত এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল কেন সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের মর্যাদা পাবে না সে প্রশ্নও তুলেছিলেন সোনম।
লাদাখকে রাজ্যের মর্যাদা দেয়ার দাবিতে গত কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন চলছে। সেই আন্দোলনের অন্যতম মুখ হন সোনম। তার বক্তব্য, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্ত করে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হোক। লাদাখের জন্য একটি পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হোক। সেই সঙ্গে লেহ এবং কার্গিল জেলার জন্য পৃথক পৃথক লোকসভা আসনের বন্দোবস্ত করা হোক। এমনই নানা দাবি নিয়ে বার বার সরব হয়েছেন বাস্তব জীবনের ‘র্যাঞ্চো’। গত বছরের গোড়া থেকে বেশ কয়েকবার অনশনেও বসেছেন।
আরও পড়ুন: ‘থ্রি ইডিয়টসের’ বাস্তব চরিত্র সোনম ওয়াংচুক আটক
লাদাখের জন্য আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও তাতে চাকরি দেয়ার আলাদা প্রক্রিয়া, খনি ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠীগুলোর হাত থেকে লাদাখের প্রকৃতিকে রক্ষা করা এবং সর্বোপরি লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতাভুক্ত করা নিয়েও বার বার সরব হয়েছেন তিনি। গত ১০ সেপ্টেম্বরও কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে অনশনে বসেছিলেন সোনম। আগামী ৬ অক্টোবর লাদাখের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু তার আগেই বুধবার লেহ শহরে বিক্ষোভ হয়ে ওঠে সহিংস।