রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন কোন অবস্থায় আছে?

২ সপ্তাহ আগে
রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের মে মাসে ধীরে ধীরে এটি শুরু হয়, যা এখনো চলছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এসে এই আক্রমণ নতুন করে মোমেন্টাম অর্জন করেছে। রাশিয়ার সেনাদের হাতে প্রায় প্রতিদিনই ইউক্রেনের নতুন নতুন গ্রামের পতন ঘটছে বলে খবর মিলছে। তারা ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ঘিরে ফেলা অথবা দখলে নেয়ার দ্বারপ্রান্তে আছে।

নির্বাচিত হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার সংকল্প করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তিনি নতুন করে হোয়াইট হাউজে প্রবেশের প্রায় ৬ মাস হতে চললো অথচ যুদ্ধ থামার নাম নেই। বরং সামনের দিনগুলোতে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।


গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে ফোনালাপ হয়। পরে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, আমার কথোপকথনে কোনও অগ্রগতি হয়নি। আমি খুবই হতাশ। পুতিন যুদ্ধ থামাতে চান বলে মনে হয় না।


পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বিবিসিকে বলেন, যুদ্ধের মূল কারণগুলো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়া তাদের বিশেষ সামরিক অভিযান চালিয়ে যাবে।


ট্রাম্পের প্রস্তাব পুতিন নাকচ করে দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রেকর্ড সংখ্যক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় রাশিয়া। শুক্রবার ইউক্রেনের বিমানবাহিনী দাবি করে, রাশিয়া ওই রাতে ৫৫০টি ড্রোন এবং ১১টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এটিকে ইউক্রেনের ওপর সবচেয়ে বড় ড্রোন হামলা হিসেবে বর্ণনা করে তারা। এরপর আরও কয়েক দফায় এমন হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনও রাশিয়ার অভ্যন্তরে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে।


যুদ্ধবিরতির আলোচনা এখন পিছনের সারিতে চলে যাওয়ায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন ইউক্রেনে নতুন ভূখণ্ড দখলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।


গত সপ্তাহে তিনি আবারো ইউক্রেনে রুশ অভিযানের পেছনে পুরনো যুক্তির পুনরাবৃত্তি করেছেন।


আমি রুশ ও ইউক্রেনীয় জনগণকে এক জাতি মনে করি। এই অর্থে, পুরো ইউক্রেনই আমাদের।


রুশ সেনারা প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার (৭৪৬ মাইল) দীর্ঘ ফ্রন্টলাইনজুড়ে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় তারা অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে।


রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সোমবার (৭ জুলাই) জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রুশ বাহিনী দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম দাচনোয়ে এবং সুমি অঞ্চলের বেসসালোভকা গ্রাম দখল করেছে। দাচনোয়ে হলো দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলে রাশিয়ার দখল করা প্রথম জনপদ।

 

আরও পড়ুন: ইউক্রেনে এবার ৩ শতাধিক ড্রোন দিয়ে রাশিয়ার হামলা


দোনেৎস্ক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর চাসিভ ইয়ার এবং এর আশপাশের সেটেলমেন্টগুলো সম্পূর্ণ দখলের নেয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে রাশিয়ার সেনারা। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া যদি চাসিভ ইয়ার দখল করতে সক্ষম হয়, তাহলে তা সম্ভবত ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্ক শহরের দিকে আরও অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দেবে। এগুলোই এখন রাশিয়ার দখলের বাইরে থাকা ডোনেৎস্ক অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বসতি।


দোনেৎস্কের আরেকটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর পোকরভস্ক। এটিও ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী। ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ওলেক্সান্দর সিরস্কি চলতি সপ্তাহে জানান, পোকরভস্কের কাছে মাত্র এক অঞ্চলেই বর্তমানে ১ লাখ ১১ হাজার রুশ সেনা মোতায়েন রয়েছে—যেখানে প্রতিদিন অন্তত ৫০টি সংঘর্ষ হচ্ছে। তার মতে, গত ডিসেম্বরে ওই এলাকাতে রুশ সেনার সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ হাজার।


গত এপ্রিলে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয়দের তাড়িয়ে দেওয়ার পর উত্তরাঞ্চলীয় সুমি অঞ্চলে অভিযোগ জোরদার করে রুশ সেনারা। তবে ইউক্রেনের সেনাপ্রধান দাবি করেছেন, রুশ বাহিনীর সুমি অঞ্চলে অনুপ্রবেশ থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।


যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার (আইএসডব্লিউ) জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী সুমিতে কিছু এলাকা পুনর্দখল করেছে এবং ওই অঞ্চলে রুশ অগ্রগতি এখন ধীর হয়ে এসেছে।


সিরস্কি বলেন, 

রুশ ভূখণ্ড থেকে শুরু হওয়া ‘গ্রীষ্মকালীন আগ্রাসনের তরঙ্গ’ এখন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে।


তবে ফ্রন্টলাইন থেকে আসা খবর তার দাবির সঙ্গে পুরোপুরি মিলছে না। ইউক্রেনীয় ওপেন সোর্স বিশ্লেষক গোষ্ঠী ডিপস্টেট জানিয়েছে, “ওই এলাকায় ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা দ্রুত ভেঙে পড়ছে এবং শত্রুর লাগাতার আক্রমণের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করছে।”

 

আরও পড়ুন: মস্কোর দিকে আসা চারটি ড্রোন ভূপাতিত করল রাশিয়া, বিমান চলাচল স্থগিত


ক্রেমলিন অনেক আগে থেকেই জোর দিয়ে বলে আসছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ডোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারবে ততক্ষণ তাদের অভিযান চলছে। এরইমধ্যে লুহানস্ক অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে রাশিয়া।


বর্তমানে যুদ্ধ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে রাশিয়ার দাবি করা বাকি অঞ্চলগুলো দখলে নিতে তাদের কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।


দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো থেকে ধারণা করা যায়, যুদ্ধবিরতির আলোচনায় তারাও আগ্রহ হারাচ্ছেন। ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্রের চালান বন্ধ করে দেওয়ার পর সোমবার ট্রাম্প নতুন করে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাবেন। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তা চালু রাখার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে।


অপরদিকে পশ্চিমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার অর্থনীতি এখন পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই সামলে চলেছেন পুতিন। তারা যে আন্তর্জাতিকভাবেও একা হয়ে পড়েননি তার প্রমাণও মিলছে ব্রিকসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে। সিএনএনের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিককে বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার পরাজয় মেনে নিতে পারবে না বেইজিং। কারণ এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি চীনের দিকে মনোযোগ দিতে পারবে। এই প্রতিবেদনের তথ্য সঠিক হলে তার অর্থ দাঁড়ায়, প্রকাশ্যে চীন নিরপেক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করলেও তলে তলে তারা রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েই যাবে।


এমন অবস্থায় ২০২৫ সাল জুড়ে সংঘাত চলতে পারে এবং ২০২৬ সালেও গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন