রামাফোসার সঙ্গে বৈঠক, দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা’র অভিযোগ ট্রাম্পের

৫ ঘন্টা আগে
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বৈঠককালে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ভিত্তিহীন এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন মতে, স্থানীয় সময় বুধবার (২১ মে) হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও রামাফোসার মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। হাসিমুখে শুরু হলেও অল্প সময়ের মধ্যে বৈঠকটি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। যা গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের প্রচণ্ড বাগযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

ট্রাম্প অভিযোগ করেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এমনকি নিজের দাবি প্রমাণ করতে একটি ভিডিও প্রদর্শন করেন। তবে জেলেনস্কির মতো বাগবিতণ্ডায় না জড়িয়ে ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্যে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করেন রামাফোসা। উত্তেজনা সৃষ্টির এই টোপ না গিলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারা শান্তভাবে কথা বলতে পারেন।

 

ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছেন, এক সময় যে সংখ্যালঘু ডাচ শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় শাসন করত, এখন তাদের বংশধরদের (যারা আফ্রিকানার বলে পরিচিত) উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বরাবর এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের একটি। কিন্তু হত্যাকাণ্ডে নিহত বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ।

 

আরও পড়ুন: জি-২০ সম্মেলনে যাবেন না বলে জানালেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

 

দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেন ট্রাম্প। যেমন দেশটির জন্য জরুরি মার্কিন সহায়তা বাতিল, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু আফ্রিকানারদের যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা ও দেশটির রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার।

 

ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার সমালোচনা করেন ট্রাম্প। এখানেই শেষ নয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক বয়কট করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও।

 

ট্রাম্প আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন, এমন প্রস্তুতি নিয়েই হোয়াইট হাউসে আসেন রামাফোসা। সফরসঙ্গী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত শ্বেতাঙ্গ গলফ খেলোয়াড়দের সঙ্গে এনেছেন। নিজেদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। দেশটির ওপর ট্রাম্প নতুন করে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।

 

নির্ধারিত সময়ে ওভাল অফিসে বৈঠক শুরু হওয়ার অল্প সময় পর ট্রাম্প দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ সামনে আনেন। তবে রামাফোসা বলেন, আফ্রিকানার গণহত্যা বলে কিছু নেই। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের কাছে (গণহত্যার) হাজার হাজার গল্প আছে’। তারপর উপস্থিত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন, ‘লাইট নিভিয়ে দাও এবং এটা (ভিডিও) চালিয়ে দাও।’

 

আরও পড়ুন: ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা আরও কমেছে: জরিপ

 

ওভাল অফিসের সাধারণত কোনো টিভি থাকে না। কিন্তু এদিন সেখানে টিভি স্থাপন করা হয়। ট্রাম্পের পাশে বসে থাকা রামাফোসা জোর করে হেসে একটি বড় টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকান। এ সময় ট্রাম্পের উপদেষ্টা দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ কারা বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ও উভয় দেশের কূটনীতিক ও সাংবাদিকরাও টিভিতে চোখ রাখেন।

 

ট্রাম্পের নির্দেশে কর্মকর্তারা একটি বড় টিভিতে একটি ভিডিও চালিয়ে দেন এবং ছাপানো খবরের কিছু কাটিং উল্টে-পাল্টে দেখাতে থাকেন। এসব ছবি দক্ষিণ আফ্রিকায় গণহত্যার প্রমাণ বলে দাবি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

 

ভিডিওতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরোধী দলীয় নেতাদের উত্তেজনাকর ভাষণের বক্তব্যও শোনানো হয়। ট্রাম্পের দাবি, ওই নেতাদের একজন জুলিয়াস মালেমা। তাকে গ্রেফতার করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

 

ট্রাম্প বলেন, ‘(দক্ষিণ আফ্রিকায়) অনেক মানুষ মনে করছেন, তাদের ওপর নিপীড়ন চলছে। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চাইছেন। যখন আমরা দেখি বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষ নিপীড়ন বা গণহত্যার শিকার হচ্ছেন, তখন আমরা তাদের আশ্রয় দিই।’ সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ কৃষককে আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

রামাফোসার কাছে অভিযোগ করে ট্রাম্প আরও বলেন, ‘মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের জমি দখল করে নেয়া হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের হত্যা করা হচ্ছে।’

 

আরও পড়ুন: হার্ভার্ডের আরও ৬ কোটি ডলারের অনুদান বাতিল করল মার্কিন প্রশাসন

 

দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের হত্যা করা হচ্ছে এবং তাঁদের জমি দখল করা হচ্ছে—এ প্রচারণা নতুন নয়। বিশ্বজুড়ে অন্তত এক দশক ধরে চরম ডানপন্থী অনলাইন ফোরামগুলোতে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি চলছে। ট্রাম্পের একান্ত মিত্র ও দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী ইলন মাস্ক এ তত্ত্ব সমর্থন করেন।

 

দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়েক শতাব্দীজুড়ে ঔপনিবেশিক শাসন ও বর্ণবাদ চালিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা। এ সময় দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের সঙ্গে চরম বৈষম্য করা হয়। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে ১৯৯৪ সালে দেশটিতে বর্ণবাদের অবসান হয় এবং  একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়।

 

দক্ষিণ আফ্রিকায় সম্প্রতি একটি ভূমি সংস্কার আইন পাস হয়েছে। এতে বর্ণবাদ যুগের অন্যায় সংশোধন করা, জনস্বার্থে প্রয়োজনে বিনা ক্ষতিপূরণে সরকারের জমি বা সম্পত্তি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। 

 

উদাহরণস্বরূপ, কোনো জমি যদি অনাবাদি পড়ে থাকে, জনস্বার্থে সরকার তা অধিগ্রহণ করতে পারবে।  তবে এ আইনের অধীন এখন পর্যন্ত কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হলে আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

 

দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশটিতে ২৬ হাজার ২৩২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪৪টি কৃষি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র আটজন ছিলেন কৃষক।

 

ট্রাম্পের এসব অভিযোগ শান্ত, স্থির ও সংযতভাবে প্রতিবাদ জানান রামাফোসা। ভিডিওতে প্রকাশিত মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি সরকারি নীতি নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। রামাফোসা বলেন, ‘যদি সত্যিই আফ্রিকান কৃষকদের ওপর গণহত্যা চলত, তাহলে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এই তিনজন ভদ্রলোক এখানে উপস্থিত হতেন না।’

 

তিনি কক্ষে উপস্থিত দক্ষিণ আফ্রিকার গলফ খেলোয়াড় আর্নি এলস, রেটিফ গুসেন ও বিলিয়নিয়ার জোহান রুপার্টের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেন। রামাফোসা আরও বলেন, ‘নেলসন ম্যান্ডেলা আমাদের শিখিয়েছিলেন যে যখনই কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তখনই মানুষের টেবিলে বসে সেগুলো নিয়ে কথা বলা উচিত। এবং আমরা ঠিক এই বিষয়েই কথা বলতে চাই।’ 
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন