রংপুরে সার সিন্ডিকেটে ‘চিড়ে চ্যাপ্টা’ কৃষক!

১ সপ্তাহে আগে
কৃষি বিভাগের দাবি অনুযায়ী, দেশে রাসায়নিক সারের সরবরাহ স্বাভাবিক। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। অভিযোগ উঠেছে, কৃষকরা সরকার নির্ধারিত দামে সার পাচ্ছেন না এবং সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে একটি শক্তিশালী ডিলার সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, গেল এক বছরে শুধুমাত্র রংপুর অঞ্চলেই এই সিন্ডিকেট শত কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিসিআইসির ডিলারদের একটি বড় অংশ সার বিক্রি না করেও নিয়মিত বরাদ্দ পাচ্ছেন। যেমন, ‘মেসার্স নুরুল অ্যান্ড ব্রাদার্স’ ডিলার পয়েন্ট নিয়মিত বরাদ্দ পেলেও সবসময়ই বন্ধ থাকে। একই চিত্র দেখা গেছে পায়রাবন্দের ইয়াকুব আলী ডিলার পয়েন্টেও। স্থানীয়রা বলেন, মাঝে মধ্যে পয়েন্ট খোলা হয়। তার মানে সহজে অনুমান করা যায় এসব সার চলে যায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে।

 

রংপুর জেলাতেই এমন সক্রিয়-বিক্রয়বিহীন ডিলারের সংখ্যা ২৮৮টি, যাদের কারণে প্রান্তিক কৃষকরা পড়েছেন সবচেয়ে বড় বিপদে। ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতারা সরকারি নির্ধারিত দাম অমান্য করে নিজেদের মতো করে দাম নির্ধারণ করছেন। একাধিক কৃষক জানান, প্রকারভেদে প্রতি কেজি সার সরকারি দরের থেকে কিনতে হচ্ছে দশ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে।

 

রংপুরের পায়রাবন্দে গ্রাহক সেজে একটি ডিলার পয়েন্ট এ সার কিনতে গেলে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ চিত্র। যেখানে প্রতি কেজি টিএসপির সরকারি দাম ২৭ টাকা, তা বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। এমওপি যেখানে ২০ টাকা, তা বিক্রি হচ্ছে ২৬ টাকায়। ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়, যা সরকারি দামের চেয়ে ৩ টাকা বেশি।

 

রংপুর কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ইউরিয়া, এমওপি ও টিএসপির বরাদ্দ দেয় ৪ লাখ ৫০ হাজার ১৭৩ মেট্রিক টন। এর সরকারি মূল্য নির্ধারণ ছিল ১ হাজার ১৩৮ কোটি ২৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে এই সার বিক্রি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৬৪ কোটি ৪১ লাখ ৮ হাজার টাকায়। অর্থাৎ, মাত্র তিন ধরনের সারে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ২২৫ কোটি ৭৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আদায় করেছে। যার পুরোটাই খেসারত দিয়েছেন প্রান্তিক কৃষক।

 

আরও পড়ুন: রংপুরে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে যুবকের কারাদণ্ড

 

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সৈয়দা সিফাত জাহান বলেন, সারের কোনো সংকট নেই। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ মিলছে। যা প্রতি মাসের টা প্রতিমাসেই ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকরা পেয়ে থাকেন। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান এই কর্মকর্তা।

 

সার নিয়ে যখন এত আলোচনা, কৃষকদের আন্দোলন এবং অভিযোগের পাহাড় এমন প্রশ্নে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে জানতে চাইলে সহকারী পরিচালক, মমতাজ বেগম বলেন, ‘অভিযোগ মূলত ডিলারদের বিরুদ্ধে। আমরা যেসব অভিযোগ পাই তাদের অধিকাংশই অভিযোগ করেন ডিলাররা দাম বেশি রাখছে। ফলে খুচরা দোকানে গিয়ে সারের দাম আরো বেশি বাড়ছে। তবে অভিযোগের ভিত্তিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার দাবি করেন এই কর্মকর্তা’।

 

কৃষক সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি পলাশ কান্তি নাগ বলেন, ‘আইনের প্রয়োগ না থাকা এবং সরকারি সার কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকার সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দেন এই কৃষক নেতা।’

 

রংপুর কৃষি অঞ্চলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাসায়নিক সারের বরাদ্দ ছিল ৭ লাখ ৩২ হাজার ১৩৯ মেট্রিক টন। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৪৫ মেট্রিক টন। তবে সারের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও বাজারে দামের লাগাম টানার উদ্যোগ খুব একটা লক্ষণীয় নয় ।

সরকারি দরে সার বিক্রির নির্দেশনা থাকলেও মাঠপর্যায়ে তার বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। ফলে মধ্যস্বত্বভোগী ডিলার ও ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের কোটি কৃষক। কার্যকর নজরদারি, আইন প্রয়োগ এবং সরকারি কারখানা সচল না করা হলে, এ লুট বন্ধ হবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন