কৈ মাছ মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মিঠা পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো Anabas testudineus। এটি তার শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বিশেষ ক্ষমতা রাখে, যার কারণে এটি পানি ছাড়াও অনেক সময় বেঁচে থাকতে পারে। এমনকি পুকুর শুকিয়ে গেলেও এটি কাদার মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে। কৈ মাছের এই বিশেষ ক্ষমতা এটিকে অন্য মাছের চেয়ে আলাদা করে তোলে। বাংলাদেশের মাছের ইতিহাসের সঙ্গে কৈ মাছের এক বিশেষ সম্পর্ক আছে। বিভিন্ন অঞ্চলে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে যশোরাঞ্চলে এটি একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।
যশোরের মাটি ও পানির বিশেষ গুণগত মান এই অঞ্চলের কৈ মাছের স্বাদে এক অসাধারণ বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। এই মাছের স্বাদ, টেক্সচার এবং পুষ্টিগুণ অন্য অঞ্চলের কৈ মাছের চেয়ে ভিন্ন।
আরও পড়ুন: যশোরে ৩৬টি স্বর্ণের বার জব্দ, আটক ৩
যশোরের কৈ মাছের বিশেষ খ্যাতি হলো এর স্থানীয় জাত। এই জাতের কৈ মাছের ত্বক পাতলা এবং মাংস নরম ও সুস্বাদু। এ বিশেষ গুণাবলীগুলিই এটিকে অন্য অঞ্চলের কৈ মাছের চেয়ে আলাদা করে তোলে। এছাড়া, এর প্রাকৃতিক খাদ্য এবং অনুকূল পরিবেশ এই অঞ্চলের মাছের স্বাদে আলাদা মাত্রা যোগ করে।
ঐতিহ্যগতভাবে, এটি সরিষা দিয়ে রান্না করা হয়, যার ফলে এর স্বাদ অতুলনীয় হয়।
বিশেষ এ স্বাদের কারণে যশোরের কৈ মাছ শুধু স্থানীয় মানুষের কাছেই নয়, সারা দেশের মানুষের কাছেই এটি সুস্বাদু এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে পরিচিত।
ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই (Geographical Indication - GI) হলো সেই পণ্যটির নাম ও পরিচিতি, যা তার উৎপত্তির স্থান এবং সেই স্থানের বিশেষ গুণাবলীর সাথে যুক্ত। সেই হিসেবে যশোরের কৈ মাছকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব, কারণ এটিও এই এলাকার মাটি, পানি এবং মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
যশোরের কৈ মাছকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। বিলুপ্ত প্রায় এই মাছের উৎপাদনকারী চাষীরা তাদের পণ্যের জন্য ন্যায্য মূল্য পাবে, যা তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে। এছাড়া, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের প্রচার এবং সংরক্ষণে সাহায্য করবে। পাশাপাশি এই উদ্যোগটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য পণ্যকেও জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করতে উৎসাহিত করবে।
এ বিষয়ে যশোরের বিশিষ্ট লেখক গবেষক বেনজীন খান বলেন, যশোরের কৈ মাছের ঐতিহ্য রয়েছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বহু লেখায় যশোরের কৈ মাছের বিশেষত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া যশোর অঞ্চলের মানুষের কাছে এ সংবাদটি যথেষ্ট পরিচিত যে, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা মাওলানা ভাসানী যশোরে আসলে তার খাবার মেন্যুতে বিশেষভাবে যশোরের কৈ মাছ থাকতে হতো।
তিনি আরও বলেন, বাংলা ভাদ্র মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত এ অঞ্চলের পর্যাপ্ত কৈ মাছ বাজারে আসতো। যশোর অঞ্চল তখন কলকাতার রাজধানী কেন্দ্রিক হওয়ায় এখানকার মোকাম থেকে মাছগুলো চলে যেত রাজধানী কোলকাতায়। কলকাতায়ও এই যশোরের কৈ এর সে কারণে সমাদর ছিল। যশোরের কৈ মাছের মাথাটা বড় হয় এবং খুব সুস্বাদু। ন্যাচারালি যশোরের কৈ মাছ এখন কম পাওয়া যায়। তবে বৃহত্তর যশোরের নড়াইলের বিল ও জলাশয়ে এখনো সেই কৈ মাছ পাওয়া যায়। ঐতিহ্য বিবেচনায় যশোরের কৈ মাছ জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত হওয়া উচিত। আর যখনই এটি নথিভুক্ত হবে তখন এটি রাষ্ট্রীয় ইস্যু হবে। তখন রাষ্ট্রের একটি দায়িত্ব পড়বে বিলুপ্ত প্রায় এই কৈ মাছকে আবার ফিরিয়ে আনা। এর উৎপাদন ও গুনাগুন নিয়ে গবেষণা করা। ফলে যশোরের কৈ মাছকে জিআই পণ্য করা উচিত।
আরও পড়ুন: যুবকের প্যান্টের পকেটে ৭০ লাখ টাকার সোনা
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের যশোর সাধু পানি উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আখেরী নাঈমা বলেন, জিআই পণ্য করতে হলে প্রমাণ করতে হবে যে, যশোরের কৈ মাছের বিশেষত্ব রয়েছে এবং এটি অন্য অঞ্চলের কৈ মাছের চেয়ে আলাদা। সর্বোপরি যশোরের কৈ যদি জিআই পণ্য করা হয় তাহলে সরকারের দায়িত্ব হবে এটাকে নিয়ে গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করার। মাছটিকে বিলুপ্তের হাত থেকে রক্ষা করতে কৃত্রিম প্রজনন করানোর জন্য তখন আমরা গবেষণা করার সুযোগ পাবো।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ও মেরিন বায়োসাইন্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমি বৃহত্তর যশোরের সন্তান। আমরা ছোটবেলায় বিল ও জলাশয় থেকে দেশি কৈ মাছ ধরেছি। এই মাছগুলো বেশ বড় বড় এবং তৈলাক্ত। বর্তমান কৈ মাছের থেকে তিনগুণ বেশি স্বাদ সম্পন্ন। আমাদের খাল বিল জলাশয় গুলো ভরাট হয়ে গেছে। কৈ মাছের প্রাকৃতিক বিচরণভূমি ও খাদ্য ভূমি নষ্ট হয়ে গেছে। সেই সাথে কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশকের কারণেও দেশি কৈ মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঐতিহ্যগত কারণে যশোরের কৈ মাছকে জিআই পণ্য করা গেলে গবেষণার মাধ্যমে এ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছের রেণু উৎপাদন করে কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সুস্বাদু এই মাছের সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতের দিকে একটি পদক্ষেপ হিসেবে যশোরের কৈ মাছকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এই উদ্যোগটি শুধু একটি মাছকে রক্ষা করবে না, বরং এটি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সবার সামনে তুলে ধরবে। এই মাছের স্বাদে এবং গুণে মুগ্ধ হয়ে মানুষ যশোরের ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হবে, যা দেশের পর্যটন শিল্পকেও উৎসাহিত করবে।
যশোরের জেলা প্রশাসক মোঃ আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো পণ্য যখন কোনো দেশের নির্দিষ্ট মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং মানুষের সৃজনশীলতা ও ঐতিহ্য মিলে তৈরি হয়, তখন সেটিকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমাদের দেশে যশোরের কৈ’র আলাদা সুনাম রয়েছে । এ অঞ্চলের মাটি, পানি ও আবহাওয়ার কারণে সুস্বাদু হওয়ায় এ সুনাম তৈরি হয়েছে। অনেক বিখ্যাত লেখক সাহিত্যিক যশোর অঞ্চলের বিবরণ দিতে গিয়ে যশোরের কৈ মাছের স্বাদের কথা উল্লেখ করেছেন। এর ঐতিহ্যগত ভিত্তি থাকায় এটা জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত হতে পারে। আমরাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি। কৈ মাছকে জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত করতে পারলে যশোরের একটি নতুন ব্র্যান্ডিং হবে।’
প্রসঙ্গত, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে যশোরের খেজুরের গুড় ইতমধ্যে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।