যেভাবে ট্রাম্পের কড়া অভিবাসন নীতির শিকার হতে যাচ্ছেন ভারতীয়রা

৩ সপ্তাহ আগে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডানপন্থি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বের বিভিন্ন অংশে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করলেও, এতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন ভারতের অনেকেই। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের কট্টরপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার ট্রাম্পের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছিল অনেক বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে।

এমনকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, ট্রাম্পের বিজয়ে যারা উৎকণ্ঠিত ভারত তাদের মধ্যে নেই। এছাড়া নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর যেসব রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধান ট্রাম্পকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন তাদের প্রথম তিনজনের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

 

শুধু রাজনৈতিক মহলই নয়, ভারতের জনগণেরও একটি বড় অংশ বিশেষ করে যারা কট্টরপন্থি রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেন, তারাও উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন ট্রাম্পের বিজয়ে। আশা করছিলেন, তীব্র চীন বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় বেইজিংকে মোকাবিলায় কাছে টেনে নেবেন ভারতকেই।

 

তবে ট্রাম্পকে ঘিরে ভারতীয়দের এই উচ্ছ্বাসের স্থায়িত্ব খুব বেশি দিন থাকছে না বলেই প্রতীয়মান। কারণ অবৈধ অভিবাসনবিরোধী হিসেবে পরিচিত ট্রাম্পের কড়া অভিবাসন নীতির সবচেয়ে বড় বলি হতে যাচ্ছে যেসব দেশ, তার মধ্যে অন্যতম ভারত। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্প ক্ষমতায় বসেই যেসব অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দিতে পারেন, সেই তালিকায় রয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার ভারতীয় নাগরিক, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

 

শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের কড়া অভিবাসন নীতির কারণে ভঙ্গ হতে পারে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে গমনের স্বপ্নও। পাশাপাশি ট্রাম্পের শাসনামলে ’এইচ-ওয়ান বি’ ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে ভারতীয়দের জন্য। দেশটির তথ্য-প্রযুক্তি খাতের কর্মীরাই মূলত সবচেয়ে বেশি এই ‘এইচ-ওয়ান বি’ ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে থাকেন।

 

আরও পড়ুন: ক্ষমতায় বসেই ১৮ হাজার ভারতীয়কে তাড়াবেন ট্রাম্প 

 

এছাড়া মেক্সিকো ও কানাডা সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরে অবৈধ অভিবাসন রোধে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যে সব দেশের নাগরিকরা এই রুট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে থাকে তাদের মধ্যে অন্যতম ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস ইনফোর্সমেন্টের (আইসিই) গত তিন বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর মেক্সিকো ও কানাডা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় আইসিই এর হাতে আটক হয়েছে গড়ে ৯০ হাজার ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী। এর মানে হচ্ছে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে দশজন ভারতীয় অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় আটক হন মার্কিন সীমান্তরক্ষীদের হাতে।

 

যে সব ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশের সময় আটক হন তাদের মধ্যে অর্ধেকই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজ জন্মস্থান গুজরাট রাজ্যের। এছাড়াও আটক ভারতীয়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাঞ্জাব রাজ্যের। অথচ এই দুটি রাজ্যকেই ভারতের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ও এগিয়ে থাকা অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

মূলত ভারতে সুশাসনের অভাব ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাবোধ থেকে দেশটির মধ্যবিত্ত বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে নিজে দেশের ব্যাপারে হতাশা তৈরি হচ্ছে। ফলে নিজের পরিবারের এবং সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক ভারতীয় মধ্যবিত্তই বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পেরে অবৈধভাবে দেশটিতে প্রবেশের বিপদজনক পথ বেছে নেন। এমনকি মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় মৃত্যুর মুখোমুখিও হন অনেক ভারতীয়।

 

পাশাপাশি এভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য মানব পাচারকারী দালালদের হাতে তুলে দিতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, যার পরিমাণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যায় মাথাপিছু ৭০ হাজার ডলার।

আরও পড়ুন: অভিবাসী ফেরত না নিলে সম্পর্ক ছিন্নের হুমকি ট্রাম্পের

 

ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্পের শাসনামলে ট্যুরিস্ট কিংবা ‘এইচ-ওয়ান বি’ ভিসা নিয়ে কড়াকড়ির কারণে বৈধ ভিসা নিয়ে কিংবা ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ আগের থেকে আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়বে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য। এতে আরও অধিক হারে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঝুঁকতে পারেন ভারতীয়রা।

 

ট্রাম্পের শাসনামলে শুধু নতুন অভিবাসনপ্রত্যাশী ভারতীয়রাই নয়, ভুগতে পারেন ইতোমধ্যেই দেশটিতে অবস্থান করা ভারতীয় নাগরিকরাও। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশটিতে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে অবস্থান করছেন। আবার অনেকেই স্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য গ্রিনকার্ডের জন্য আবেদন করেছেন। ট্রাম্পের কড়া অভিবাসন নীতির বলি হতে পারেন তারাও।

 

ইতোমধ্যেই নিজের ক্যাবিনেটের ইমিগ্রেশন বিষয়ক প্রধান হিসেবে টম হোমানের নাম ঘোষণা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যিনি কট্টর অভিবাসী বিরোধী হিসেবে পরিচিত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের আগের দফার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস ইনফোর্সমেন্টের (আইসিই) ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে খুবই কঠোর ও নির্দয়ভাবে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি।

 

বিশেষ করে শিশুদের কাছ থেকে অবৈধ অভিবাসী অভিভাবকদের আলাদা করার মতো নিষ্ঠুর নীতিও গ্রহণ করেছিলেন টম হোমান। এই টম হোমানকেই আবার নিজের অভিবাসন বিষয়ক প্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

আরও পড়ুন: ট্রাম্প প্রশাসনের গুরত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন মার্কিন ধনকুবেররা

 

ইতোমধ্যেই অবৈধ ও কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীদের বের করে দেয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপারেশন পরিচালনারও অঙ্গীকার করেছেন টম হোমান। অভিবাসী বিরোধী টম হোমানের এসব কার্যক্রমের অন্যতম শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছেন ভারতীয়রা। যাদের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেছেন এইচ-১বি ভিসা নিয়ে।

 

আইসিই’তে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে টম হোমানের দায়িত্ব পালনের সময় যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে গিয়েছিল ‘এইচ-ওয়ান বি’ ক্যাটাগরির ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের নতুন ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু কিংবা ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি অথবা নিজের স্বজনদের যুক্তরাষ্ট্রে আনার বিষয়টিও কঠিন করে তুলেছিলেন টম হোমান। টম হোমানের আইসিই প্রধান হিসেবে হিসেবে নিয়োগের বিষয়টিতে তাই স্বভাবতই উদ্বিগ্ন মার্কিন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা।

 

এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ল স্কুলের অভিবাসন আইন বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন ইয়েল লোয়ের বলেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার শাসনামলে অবৈধ ও বৈধ উভয় শ্রেণির অভিবাসীরাই আক্রান্ত হবেন। ট্রাম্পের প্রথম দফার প্রেসিডেন্সিতে তার অভিবাসন নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এইচ-১বি ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসা কর্মীরা। তাদের ভিসা প্রক্রিয়াকরণের সময় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়ে গিয়েছিল ভিসা প্রত্যাখ্যানের হারও। ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্সিতেও একই কাজ করতে যাচ্ছে তার প্রশাসন।

 

অপরদিকে ভারতের ২৫৪ বিলিয়ন ডলারের আইটি ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় ভোক্তা যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিতে ভারতীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। যদি এইচ-১বি ভিসা নিয়ে নিজের প্রথম দফার শাসনামলের মতো একই নীতির পুনরাবৃত্তি করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তবে তা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর- এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

এ ব্যাপারে নিউইয়র্ক ভিত্তিক আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সাইরাস ডি মেহতা অ্যান্ড পার্টনার্সের ম্যানেজিং পার্টনার সাইরাস ডি মেহতা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, ট্রাম্পের এই কঠোর অভিবাসন নীতির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শাসনামলে আমরা এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন