যে বদ অভ্যাসগুলোর কারণে কবরে শাস্তি হয়

৪ সপ্তাহ আগে
ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে পরকালের আগে যে জগৎ আছে, সেটিকে বলে আলমে বরযখ। কবরের জগৎ। ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। কবরের জগতেও মানুষ দুঃখ-কষ্টে থাকবে। যদি ‍দুনিয়াতে খারাপ কাজ করে তাদের কবর থেকেই শাস্তি শুরু হয়। কবরের শাস্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মানুষকে তাদের জীবনের গুণাবলি সম্পর্কে সতর্ক করে।

মিথ্যা বলা

 

মিথ্যা বলা একটি মারাত্মক পাপ বা গুনাহের কারণ। কোরআন ও হাদিসে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মিথ্যা শুধু সমাজের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না, বরং এটি ঈমানের অভাবের প্রতীক। হাদিসে বলা হয়েছে, মিথ্যা বলার কারণে মানুষের উপর কবরের শাস্তি কঠোর হতে পারে।  মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পেছনে পড়ে থেকো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও হৃদয় এসবের ব্যাপারে (কিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল ৩৬)

 

আরও পড়ুন: অনুগত সন্তান লাভের দোয়া


মহান আল্লাহ আরো বলেন, (অনুমানভিত্তিক) মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক। (সুরা জারিয়াত, আয়াত ১০) মুবাহালাসংক্রান্ত আয়াতে এসেছে, অতঃপর আমরা সবাই (আল্লাহর কাছে) এ মর্মে প্রার্থনা করি যে মিথ্যুকদের ওপর আল্লাহর লানত পতিত হোক। (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৬১) 

 

মিথ্যা কখনো কখনো মিথ্যাবাদীকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় এবং মিথ্যা বলতে বলতে পরিশেষে সে আল্লাহ তাআলার কাছে মিথ্যুক হিসেবে পরিগণিত হয়। ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 

 

তোমরা সত্যকে আঁকড়ে ধরো। কারণ সত্য পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। কোনো ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বললে এবং সর্বদা সত্যের অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকো। কারণ মিথ্যা পাপাচারের রাস্তা দেখায় আর পাপাচার জাহান্নামের রাস্তা। কোনো ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বললে এবং সর্বদা মিথ্যার অনুসন্ধানী হলে সে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত হয়। (মুসলিম, হাদিস : ২৬০৭)

 

নামাজে অবহেলা করা

 

নামাজ ইসলামের প্রধান স্তম্ভগুলোর একটি। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের জন্য ফরজ বিধান নামাজ। যারা নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করতে অবহেলা করে, তারা আল্লাহর আদেশের অবমাননা করে। ইসলামি শিক্ষায়, নামাজে অবহেলা করলে কবরের শাস্তি হয়। হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে কবরের শাস্তির একটি বড় কারণ হলো নামাজের অবহেলা।

 

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, হাশরের দিন এক ব্যক্তিকে আল্লাহর সামনে দাঁড় করানো হবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেবেন। সে আরজ করবে, হে আল্লাহ! কী কারণে এ নির্দেশ? আল্লাহ বলবেন, নামাজ নির্ধারিত সময়ের পরে পড়া এবং আমার নামে মিথ্যা শপথ করার জন্যে।

 

একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদের জন্য দুয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমাদের কাউকে বিরত ও হতভাগা করো না, অতঃপর উপস্থিত সাহাবাদেরকে (রা.) প্রশ্ন করলেন তোমরা কী জান? কে বিরত ও দুর্ভাগা? সাহাবাগণ (রা.) বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! কে সে ব্যক্তি? তিনি বললেন নামাজ ত্যাগ কারি।

 

বর্ণীত আছে, বনি ইসরাঈলের এক মহিলা হজরত মুসা (আ.) এর নিকট এসে বলল ‘হে আল্লাহর নবী! আমি এক জঘন্য গুনাহ করেছি, অতঃপর তা থেকে আল্লাহর কাছে তওবাও করেছি। আপনি দোয়া করুন আল্লাহ যেন আমাকে মাফ করে দেন এবং আমার তওবা কবুল করেন। হজরত মূসা (আ.) জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি কী পাপ করেছো?’ সে বলল ‘আমি যিনায় লিপ্ত হয়ে একটি সন্তান প্রসব করেছি এবং তাকে হত্যা করে ফেলেছি।’

 

আরও পড়ুন: মাছের পেটে যে অবস্থায় ছিলেন ইউনুস আ.

 

হজরত মুসা (আ.) বললেন 

 

হে পাপিষ্ঠ! এ মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাও। নচেৎ আকাশ থেকে আগুন এসে আমাদেরকেও জ্বালিয়ে ফেলবে। ’ মহিলাটি ভগ্নহৃদয়ে চলে গেল। তখনি জিবরাইল (আ.) এসে বললেন ‘হে মুসা (আ.)! আল্লাহ জানতে চেয়েছেন, কী কারণে আপনি এ তওবা কারিণীকে দূরকরে দিলেন? তার চেয়ে বড় পাপী কে আপনি জানেন?’ মুসা (আ.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে জিবরাঈল! এর চেয়েও বড় পাপী আর কে হতে পারে?’ জিবরাঈল (আ.) বললেন ইচ্ছাকৃত ভাবে নামাজ ত্যাগকারী।  

 

 

আরো বর্ণিত আছে এক বুযুর্গ ব্যক্তি তার বোনকে দাফনের সময় তার টাকার থলেটি কবরের ভেতরে পড়ে যায়। দাফন শেষে বাড়ি ফিরে থলের কথা মনে পড়লো কবরের ভেতরে পড়ে গেছে। তিনি কবর খুঁড়লেন। দেখতে পেলেন, কবরে আগুন জ্বলছে। তিনি আবার মাটি চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে বোনের আমলের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। সব শুনে মা বললেন, ‘তোমার বোন নামাজে অবহেলা করত।’

 

জিনা করা

 

জিনা করা বা ব্যভিচার কঠোরভাবে হারাম। এটি ইসলামে একটি কবিরা গুনাহ বা বড় গুনাহ। যে গুনাহ তওবা ছাড়া মাপ হয় না। এ ধরনের একটি গুনাহই জাহান্নামে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট। তবে আল্লাহ তাআলা কোরআন এবং হাদিসে জিনা করার জন্য কঠোর শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। যারা এই পাপ করে এবং তওবা করে না, তারা কবরের আজাবে পতিত হতে পারে।

 

আল্লাহ বলেন, 

 

তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। কারণ তা হলো অশ্লীল এবং নোংরা পথ। (সুরা ইসরা ৩২)

 

নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ব্যভিচার ব্যাপক আকারে প্রসার লাভ করা এই কথার ইঙ্গিত যে, কিয়ামত অতি নিকটে আসছে। (বুখারি ৮১, মুসলিম ২৬৭১)

 

সুদ খাওয়া

 

সুদ নেয়া বা দেয়া ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সুদ খাওয়ার প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিকভাবে ধ্বংসাত্মক। হাদিসে বলা হয়েছে যে সুদখোরদের কবরের মধ্যে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে।

 

আল্লাহ তাআলা বলেন, 

 

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো এবং সুদের যা অবশিষ্ট রয়েছে তা বর্জন করো যদি তোমরা মু’মিন হওয়ার দাবি করে থাকো। আর যদি তোমরা তা না করো তাহলে আল্লাহ তাআলা ও তদীয় রসুলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। (বাক্বারাহ ২৭৮-২৭৯)

 

অহংকার করা

 

অহংকার করা একটি মারাত্মক মানসিক অসুস্থতা যা মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে। ইসলামে অহংকার আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে ক্ষুণ্ন করে এবং কবরের শাস্তি ডেকে আনতে পারে। হাদিসে অহংকারীদের কবরের শাস্তির বর্ণনা রয়েছে।

 

আরও পড়ুন: আল আকসা যে কারণে মুসলিম-ইহুদি-খ্রিস্টান সবার কাছে প্রিয়

 

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সে (ইবলিশ সম্মানিত আদমকে সিজদার মাধ্যমে সম্মান করতে) অস্বীকার করল এবং অহংকার করল, পরিণতিতে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ (সুরা-২ বাকারা ৩৪)

 

‘অহংকার’ মানব স্বভাবের একটি নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য অংশ। অহংকার কী? হাদিস শরিফে রয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অহংকার হচ্ছে সত্যকে উপেক্ষা করা এবং মানুষকে অপমান-অসম্মান ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।’ (মুসলিম: ৯১)

 

প্রস্রাব থেকে পবিত্র না হওয়া

 

ইসলামে পবিত্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং প্রস্রাবের পবিত্রতা রক্ষা করা এর মধ্যে অন্যতম। অনেক হাদিসে উল্লেখ আছে যে যারা প্রস্রাবের পরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে না, তাদের কবরের আযাবে পড়তে হতে পারে। ইসলামি শিক্ষায় এটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, বেশিরভাগ কবরের ‘আজাব প্রস্রাবের কারণে হয়। (মুসনাদে আহমদ ৮৩১৩, সহিহ তারগিব ১৫৮)

প্রস্রাবের ফোঁটা বন্ধ না হতেই যে দ্রুত প্রস্রাব থেকে উঠে পড়ে কিংবা এমন কায়দায় বা স্থানে প্রস্রাব করে যেখান থেকে প্রস্রাবের ছিটা এসে গায়ে বা কাপড়ে লাগে সেও এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে।

 

মুনাফিকি করা

 

মুনাফিকি বা কপটতা হলো একজন ব্যক্তির বাইরের কার্যকলাপ এবং অন্তরের বিশ্বাসের মধ্যে অমিল। কোরআনে মুনাফিকদের কঠোরভাবে সমালোচনা করা হয়েছে এবং তাদের জন্য কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুনাফিকদের কবরের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর হতে পারে, কারণ তারা ইসলামের মূল আদর্শকে অবজ্ঞা করে।


‘মুনাফিক’ শব্দটি ‘নিফাক’ শব্দমূল থেকে এসেছে, যার অর্থ কোনো কিছুকে গোপন রেখে এর বিপরীত কথা বা কাজ প্রকাশ করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যে অন্তরে কুফরি ও ইসলামবিরোধিতা রেখে মুখে ও প্রকাশ্যে ইসলাম প্রকাশ করে এবং মুসলমান হওয়ার দাবি করে।

 

এরা কেন এ কাজ করে, এর ব্যাখ্যায় কোরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহ ও মুমিনদের ধোঁকা দিতে চায়, আসলে তারা নিজেদের সঙ্গেই প্রতারণা করছে, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারছে না। (সুরা বাকারা ৯। অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা মূলত কাফিরদের কাছ থেকে মান-মর্যাদা পেতে চায়। (সুরা নিসা ১৩৯)

 

এই অভ্যাসগুলো কবরের শাস্তির কারণ হতে পারে এবং প্রত্যেক মুসলিমের উচিত এই ধরনের কাজগুলো থেকে বিরত থাকা এবং তওবা করা।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন