যে কারণে আরবের লোকেরা নবীজিকে আল-আমিন উপাধি দিয়েছিলেন

২ সপ্তাহ আগে
আরব উপদ্বীপের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এক অদ্ভুত বিস্ময়কর চরিত্রের নাম মুহাম্মদ ইবনু আব্দুল্লাহ। মক্কার কঠিন মরুভূমি, গোত্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব, প্রতিহিংসা, রক্তপাত, এবং বিশ্বাসঘাতকতার মাঝে এক ব্যক্তি আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন,সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও পরিশুদ্ধ চরিত্রের প্রতীক হয়ে।

শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত, তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ এমনই এক আলোর রেখা ছড়িয়েছিল, যা আরবের ঘন আঁধার কেটে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিল। এমনই অসাধারণ সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার কারণেই আরববাসী তাঁকে এক অনন্য উপাধিতে ভূষিত করেছিল,  আল-আমিন  (ٱلْأَمِينُ) অর্থাৎ  সবচেয়ে বিশ্বস্ত, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য।

 

নবীজির শৈশব থেকে বিশ্বস্ততার খ্যাতি

 

হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শৈশবেই পিতৃহীন, অল্প বয়সেই মাতৃহীন। ছোট্ট বয়সে দাদা  আব্দুল মুতালিবের এবং পরে চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছেন। তবুও কঠিন জীবনের নানা পরীক্ষার মধ্যেও তিনি কখনো অসততার পথে হাঁটেননি।

 

আরও পড়ুন: নবীজির জন্মের আগে আরবের সামাজিক অবস্থা যেমন ছিল

 


ইবনু হিশাম ও ইবনু ইসহাকের সিরাতের বিবরণে এসেছে, কিশোর বয়সেই তিনি পশুপালনের কাজ করতেন এবং পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যদের ভেড়া চরাতেন। (সহিহ বুখারি:২২৬২) সেই সময় থেকেই তাঁর সত্যবাদিতা এবং অসাধারণ আমানতদারিত্ব গোত্রের মানুষদের চোখে ধরা পড়েছিল।

 

সততার পরীক্ষা: বাণিজ্যে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

 

যৌবনে তিনি মক্কার বাণিজ্যিক জীবনে প্রবেশ করেন। সে সময়ে আরববাসীরা দূরদেশে কাফেলা নিয়ে ব্যবসা করতো। কিন্তু প্রতারণা, সুদ, শপথভঙ্গ এবং ধোঁকাবাজি তখন বাণিজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। কিন্তু নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। কখনো কারও হক নষ্ট করতেন না, কখনো মিথ্যা বলতেন না, কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতেন না। 


এমন সততার খবর মক্কার সম্ভ্রান্ত মহিলা ব্যবসায়ী খাদিজা রা.-র কানে পৌঁছায়। তিনি তাঁর পণ্য নিয়ে নবীজিকে সিরিয়ায় পাঠান। আল্লাহর রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে ফিরে আসেন, এবং খাদিজা রা. তাঁর সততা, লেনদেনের স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততায় এতটাই মুগ্ধ হন যে, পরবর্তীতে তিনিই নবীজির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। (ইবনু হিশাম, সিরাতুন্নবি:১/১৮৪)।

 

আল-আমিন উপাধি অর্জনের ঘটনা

 

ইসলামি ইতিহাসবিদদের মতে, নবীজি যখন প্রায় ২৫ বছর বয়সী, তখন মক্কার প্রায় প্রত্যেক মানুষই তাঁকে এক নামে ডাকত,আল-আমিন। কারণ , তিনি কখনো কারও অমানত ভঙ্গ করেননি। কখনো মিথ্যা বলেননি। কখনো অন্যের সাথে প্রতারণা করেননি। ইবনু কাসির রহ. লিখেছেন,

 

وكان أهل مكة يسمونه الأمين لما يعلمون من صدقه وأمانته মক্কার লোকেরা তাঁকে আল-আমিন বলে ডাকতো, কারণ তারা তাঁর সত্যবাদিতা ও আমানতদারিত্ব সম্পর্কে অবগত ছিল। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া:২/ ২৯৩)

 

কাবা পুনর্নির্মাণের সময় আল-আমিন-এর স্বীকৃতি

 

একবার মক্কার কুরাইশরা কাবা শরিফ পুনর্নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের ক্ষেত্রে তীব্র দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেক গোত্রই চেয়েছিল, এই মহিমান্বিত কাজটি তারাই করুক। অবশেষে যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিল। তখন প্রস্তাব করা হলো, যে ব্যক্তি সবার আগে কাবার দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, তাকেই বিচারক ধরা হবে।

 

সেই মুহূর্তে নবীজি প্রবেশ করলেন। সবাই একসাথে বলে উঠল, ইনি হলেন, আল-আমিন! রদিনা! রদিনা! এই তো আল-আমিন! আমরা রাজি! আমরা রাজি! তিনি রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত প্রজ্ঞার সাথে সমাধান দিলেন, একটি কাপড়ের ওপর হাজরে আসওয়াদ রাখলেন, চারপাশ থেকে চার গোত্রকে ধরে তুলতে বললেন, এবং নিজ হাতে তা বসিয়ে দিলেন। এভাবেই রক্তক্ষয় এড়িয়ে কুরাইশদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। (সিরাতু ইবনি হিশাম:১/২২০)।

 

কুরআনের স্বীকৃতি

 

وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ . إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ তিনি নিজের মন থেকে কথা বলেন না। এটি তো শুধু ওহি, যা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়। (সুরা নাজম: ৩-৪) এগুলোই প্রমাণ করে, নবীজির সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চরিত্র ও বক্তব্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না।  রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

 

آيةُ المنافقِ ثلاثٌ: إذا حدَّثَ كذبَ، وإذا وعدَ أخلفَ، وإذا اؤتُمِنَ خانَ মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ: কথা বললে মিথ্যা বলে, প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করে, আর অমানত পেলে খেয়ানত করে। (সহিহ বুখারি:৩৩) নিজের জীবনে তিনি এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন, তাই তো তিনি আল-আমিন।


 

রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র এমন এক আলোকস্তম্ভ, যা শুধু মক্কার গলিঘুঁজি নয়, সমগ্র পৃথিবীর অন্ধকার পথকে আলোকিত করেছে। আল-আমিন উপাধি শুধুমাত্র একটি নাম নয়; এটি মানবজাতির জন্য সততা, বিশ্বস্ততা ও চরিত্রগুণের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত। আজকের সমাজে যখন প্রতারণা, মিথ্যাচার ও আমানতের খেয়ানত আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, তখন রসলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই আল-আমিন চরিত্রই আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন