বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলা এই বাজারে প্রায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় বণিক সমিতি।
যশোর শহরে থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্বে মনিরামপুর উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত ঢাকুরিয়া ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের ঢাকুরিয়া প্রতাপকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রতি বছর দুর্গাপূজার দশমীর দিনে বসে জামাই বাজার।
শুক্রবার বিকালে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন বয়সের ও ধর্মবর্ণের শত শত বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এ বাজারের মূল আকর্ষণ ছিল বড় আকারের কাতলা, রুই, ব্ল্যাক কার্প, গ্লাস কার্প, পাঙাশ, সিলভার কার্প-সহ বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু মাছ। একেকটা মাছের ওজন ৫ থেকে ১৩ কেজি পর্যন্ত। সকাল থেকে মেয়ে জামাইরা সবচেয়ে সেরা ও বড় মাছটি কিনতে ভিড় করেন বাজারে। এরপর শুরু হয় জামাইদের প্রতিযোগিতামূলক দরদাম এবং বড় মাছ কেনার হিড়িক। যা বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। জামাইরা এই মাছ নিয়ে যাবেন শ্বশুর বাড়িতে, সাথে মুখরোচক খাবারও। এ দিয়েই আনন্দ উদযাপন করবেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
সময়ের সাথে সাথে ব্যতিক্রমী এই মেলা উৎসবে পরিণত হয়েছে। একদিনের মাছের মেলায় বিক্রি হয় কোটি টাকার মাছ! কারণ বাজারমূল্যের চেয়ে মেলায় কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি হয় মাছ।
স্থানীয়দের অভিমত হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষই এখানে আসেন এবং সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে নিয়ে যান। ফলে বিশেষ বাজারটি এ অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও লোক-সংস্কৃতির প্রতীক উঠে।
একহাতে সাড়ে ৮ কেজি ওজনের কাতলা মাছ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন প্রদীপ কুমার বাইন। মেলা মাঠে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘মেলার সামনে রাস্তায় একটি ভ্যানে বউ আর মেয়ে বসে আছে। চিনেতলায় শ্বশুর বাড়ি। প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিনে শ্বশুর বাড়ি যায়। যাওয়ার সময় এই মেলা থেকে বড় মাছ নিয়ে যায়। মাছের সঙ্গে মুড়ি মুড়কি, জিলাপিও। শ্বশুর বাড়িতে আনন্দ করে সবাই চলে খাওয়া-দাওয়া।’
শ্যামল বিশ্বাস নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাজারে মাছ কম দেখছি। এলাকার জামাইদের প্রতিযোগিতা করে মাছ কেনার অঘোষিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মনিরামপুর না, অভয়নগর ও সদর উপজেলার লোক এসেও এখান থেকে মাছ কিনে যায়। শুধু যে হিন্দু ধর্মের মানুষ মাছ কিনে এটা কিন্তু না; মুসলিম ধর্মের মানুষ দল বেঁধে এসে মাছ কিনে যায়। তিনি জানালেন সাড়ে ৮ শ’ টাকা কেজি করে সাড়ে চার কেজি ওজনের মাছ নিয়েছি।’
আরও পড়ুন: অনুমতিহীন মেলায় হেলে পড়ল চলন্ত নাগরদোলা, আহত ৫
এ মেলায় ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ বিক্রি করেন শংকর বিশ্বাস। তিনি বলেন, আমার নিজস্ব একটা ঘের রয়েছে। সেই ঘের থেকে আজ ভোরে মাছ ধরে ১০টার দিকে মেলায় মাছ এনেছি। মেলায় রুই, কাতলা বেশি চলে। তাই ঘেরের সবচেয়ে বড় বড় ৬৫টি মাছ ধরে মেলায় এনেছি। সবচেয়ে বড় সাড়ে ১২ কেজি ওজনের মাছ বিক্রি করেছি।
তিনি বলেন, দূরদূরান্ত থেকে এখানে মাছ কিনতে আসে। শুধু জামাইরা না; বিভিন্ন বয়সী মানুষ এখানে আসে। তবে এবার বড় মাছের দিকে ঝোক কম। তারপরও জামাইদের মনস্তাত্ত্বিক এই প্রতিযোগিতায় বড় মাছই আসল কেন্দ্রবিন্দু।’
স্থানীয়রা জানান, মেলা ঘিরে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের বাড়িতে মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনিরা এসে ভরে গেছেন। তাদের মেলার মাছসহ বিভিন্ন খাবার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হরেক রকম পুলিপিঠাও রয়েছে। অনেক জামাই মেলা থেকে সাধ্যমতো মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে ফেরেন। তবে এই মেলাটি অনেক বিক্রেতা মাছের পরসা বসালেও সম্প্রতি একটি দ্বন্দ্বে মেলার একটি অংশের বিক্রেতারা মেলায় দোকান বসায়নি। তারা বসিয়েছে বাজারের মূল মাছ বাজারে। ফলে মেলায় বিক্রেতাও কম।
এদিকে ঢাকুরিয়া প্রতাপকাটি বাজার বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান গাজী বলেন, ‘১৯৫০ সাল থেকে এই মেলা বসে। মেলায় এখানকার একটি ঐতিহ্য। এখানকার জামাইরা প্রতিযোগিতা করে মাছ কেনে। মেলাকে ঘিরে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানও বসে। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। সকাল ১০টা থেকে রিত ১০টা পর্যন্ত দিনব্যাপী এই মেলায় প্রায় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয় বলে দাবি করেন তিনি।’