যশোরে আওয়ামী দুঃশাসনে নির্যাতিতদের ব্যতিক্রমী মিলনমেলা

৩ সপ্তাহ আগে
ব্যতিক্রম এক মিলনমেলা হয়ে গেল যশোরে। এ মিলনমেলায় অংশ নিয়েছিলেন আওয়ামী দুঃশাসনে মামলা, হামলা, জেল জুলুমের মাধ্যমে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার বিএনপি নেতাকর্মীরা। তাদের সাথে অংশ নিয়েছিলেন জামায়াত ইসলামী, জাসদ, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারা।

রোববার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে অভিনব এ আয়োজন মিলিত হয়ে আনন্দ উল্লাসে সময় কাটিয়ে খুশি সকলে। নেতাদের দাবি, এ উদ্যোগ রাজনৈতিক সহকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে ভূমিকা রাখবে।


গত ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বিরোধী মতের নেতাকর্মীরা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করতে দেয়া হয়েছে একাধিক মামলা। একেকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৪০'র অধিক মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় কারান্তরীণ থাকার পাশাপাশি বাড়ি ছেড়ে পলাতক জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন তারা।  গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এলাকায় ফিরেছেন তারা। নিপীড়িত এসব নেতাকর্মীদের এক জায়গায় করতে ও দুঃখ কষ্ট ভাগাভাগি করে নিতে যশোর সদর উপজেলা বিএনপির উদ্যোগে আয়োজন করা হয় মিলনমেলার। 


বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি জামায়াত ইসলামী, জাসদ, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এ মিলন মেলায় মিলিত হয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন। সেইসঙ্গে গত ১৬ বছরের যাপিত জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। তারা জানান, এমন আয়োজন অংশ নিতে পেরে তারা অত্যন্ত খুশি।

আরও পড়ুন: প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরূপ সম্পর্কে চায় না বিএনপি: নজরুল ইসলাম খান


আব্দুল হালিম নামে এক বিএনপি কর্মী বলেন, ‘শুধুমাত্র বিএনপি করার কারণে আমাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা দেয়া হয়। এ মামলার কারণে আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দুই দিন গুম করে রাখা হয়। তারপর নেতাদের তৎপরতায় আমাকে আটক দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়। বিনা বিচারে দুই বছর তিন মাস আমাকে জেলখানায় রেখেছে। জামিন দেয়নি। উচ্চ আদালত আমাকে জামিন দেয়নি কারণ আমি শেখ হাসিনাকে ভোট চোর বলেছিলাম।’


তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা জেল জুলুমে কষ্ট ভোগ করেছি, তাদের কথা নেতারা মনে রেখেছে, আজকে আমাদের ডেকেছে। এতে আমরা খুব খুশি। আমাকে কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ করেছে এতে আমার সারা জীবনের গ্লানি শেষ হয়ে গেছে এবং আমি শান্তি পেয়েছি।’


আবু জাফর নামে অপর এক বিএনপিকর্মী বলেন, ‘ঘর পোড়ানো ও নাশকতার দুটো মামলা ছিল আমার নামে। রাতে বাড়ি ঘুমাতে পারিনি। মানুষের বাড়ি, বন জঙ্গলে রাত কেটেছে। আমাদের সেই কষ্টের কথা মনে রেখে আজকে আমাদের ডেকেছে এতে আমরা অত্যন্ত খুশি।’


আব্দুস সালাম নামে এক বিএনপি কর্মী বলেন, ‘কেবল মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়নি। জেলখানাতেও কষ্টে ছিলাম। অনেক সময় খাবার পেতাম না। ঝাল পেঁয়াজ দিয়ে খাবার খেতে হয়েছে। আজকে মিলন মেলায় এসে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। আওয়ামী দুঃশাসনের নির্যাতন নিপীড়নের দুঃখ কষ্ট সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পেরে ভালো লাগছে।’

বিএনপিকর্মী অ্যাডভোকেট মোস্তফা কামাল মিন্টু বলেন, ‘আমি আইনজীবী হয়েও আওয়ামী মামলা, জেল জুলুম থেকে রেহাই পাইনি। আমাকে ২৬টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। আজকে আমার মতো নির্যাতিত জেলখাটা নেতাকর্মীরা এখানে একত্রিত হয়েছে। এটা আমাদের আগামীতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে সাহায্য করবে।’


জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা আমীর ফয়সল বলেন, ‘আমার বয়স চল্লিশ অথচ আমি ৪২ মামলার আসামি। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক এসব মামলায় অসংখ্যবার কারাগারে গেছি। মাসের পর মাস বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। ১৭ বছরের আন্দোলনের চুড়ান্ত ফল এনে দিয়েছে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুথান। শেখ হাসিনার পতনের পর ৮০ শতাংশ ক্লান্তি দূর হয়েছে। আজকের মিলন মেলায় আমরা আবেগ আপ্লুত এবং সকল গ্লানি মুছে গেছে।’


জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আনসারুল হক রানা বলেন, ‘আজকের আয়োজনে এসে খুব ভালো লাগছে। আমি ৪৩ টি মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছি। আমার সাথে যারা আন্দোলন সংগ্রামে ছিল, জেলে খেটেছে তাদের সাথে আজ দেখা হয়েছে, কুশল বিনিময় হয়েছে, ভালো লাগছে। এটি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান। আগামীর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে আজকের এ অনুষ্ঠান থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার শপথ নিচ্ছি।’


জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘আমার নামে ৪৩টা মামলা রয়েছে। বহুবার জেলখানায় গিয়েছি। এখানে যারা আসে তাদের অনেকের সাথে আমি জেল খেটেছি। ভালো লাগছে আজকে সবার সাথে দেখা হয়ে। এখানের সকলেই একই রকম নির্যাতনের শিকার।’


তিনি আরও বলেন, ‘আমরা রাজপথে ছিলাম এখনও আছি। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে লড়াই চলমান, সে লড়াইয়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আজকে যারা নির্যাতিত নিপীড়িত তাদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে এ আয়োজন ভূমিকা রাখবে।’

আরও পড়ুন: এ বছরই নির্বাচন চায় বিএনপি: আমীর খসরু


বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘গত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সারা দেশের লাখ লাখ বিএনপি নেতাকর্মী মামলা, জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। আমাদের যশোর সদর উপজেলার আড়াই হাজারের অধিক নেতাকর্মী হয়রানীমূলক মামলার শিকার হয়েছেন। তারা জেলে গেছেন এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদের পতনের পর আমরা মনে করেছি, রাজপথে যাদের অবদান ছিল, দেশের স্বার্থে যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদেরকে সম্মান দেয়া উচিত। তাদের একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধ শক্তি গড়া উচিত। যাতে করে আগামীর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে আমরা কাজ করতে পারি।’


তিনি আরও বলেন, ‘শুধু বিএনপির রাজনৈতিক কর্মীরা এই আত্মত্যাগ করিনি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ সমাজের সব শ্রেণীপেশার মানুষ তাদের অবস্থান থেকে কাজ করেছে। আমরা তাদেরকেও আজ একত্রিত করেছি। কারণ আমরা সবাই মিলেই আগামীর বাংলাদেশ গড়তে চাই।’


যশোর জেলা জামায়াতে ইসলামের আমীর অধ্যাপক গোলাম রসুল বলেন, ‘বিএনপি নির্যাতিত নেতাকর্মীদের নিয়ে যে মিলনমেলা করছে সেটাকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। গত ১৫-১৬ বছরে যারা নির্যাতিত হয়েছে তাদেরকে মূল্যায়ন করা হলো। আমাদেরকেও এখানে আমন্ত্রিত করায় আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যশোরে জামাত ও বিএনপি'র বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি মামলা ছিল। সবচেয়ে বেশি এই দুই দলের নেতাকর্মীরা কারাবরণ করেছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একই সাথে ছিলাম, এখনও আছি। আমরা জাতীয় ঐক্য চাই। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে থাকি তাহলে নতুনভাবে কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে না।’


যশোর জেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, ‘এটা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমাদের দেশের রাজনৈতিক কালচারটা কাঁদা ছোড়াছুড়ির। পরস্পর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে যে রাজনীতি করা যায় আজকের অনুষ্ঠান তার প্রমাণ। আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলছি, সব মত পথের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে এ ধরনের অনুষ্ঠানের দরকার। আজকে এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াটা সুন্দর হবে। কারণ দিনশেষে আমাদের উদ্দেশ্যটা জনগণের জন্য কাজ করা।’

আরও পড়ুন: এবার বিলবোর্ডে ভেসে উঠল ‘আওয়ামী লীগ’ ‘শেখ হাসিনা ফিরবে আবার বীরের বেশে’


প্রসঙ্গত, যশোর শহরতলীর বাহাদুরপুরের একটি পার্কে আয়োজিত এ মিলন মেলায় প্রায় ৪ হাজার নেতাকর্মী অংশ নেন।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন