গত ২৭ জুলাই রাত সোয়া ৯টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকার ঢাকনা খোলা ম্যানহোলে পড়ে নিখোঁজ হন জ্যোতি। রোববার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত দফায় দফায় উদ্ধার অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। অবশেষে ৩৬ ঘণ্টা পর ২৯ জুলাই সকাল ৯টার দিকে টঙ্গী এলাকার শালিকচুড়া (টেকপাড়া) বিল থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার হয়।
জ্যোতি চুয়াডাঙ্গা শহরের বাগানপাড়া এলাকার বাসিন্দা এবং পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মৃত বাবলুর মেয়ে। তিনি রাজধানীর মিরপুরে আট বছর বয়সী দুই জমজ ছেলে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন এবং মনি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল হেলথ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।ফারিয়া তাসনিম জ্যোতির ঢাকনা বিহীন ম্যাহোলে পড়া থেকে শুরু করে মৃত দেহ উদ্ধার সারাদেশেই ব্যাপক আলোচিত হয়। এদিকে এই হৃদয় বিদারক ঘটনাকেই কেন্দ্র করে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র অর্থ সহায়তার নামে প্রতারণা করছেন বলে নজরে এসছে জ্যোতির পরিবারের।
জ্যোতির বড় ভাই হাসানুজ্জামান লোটন বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, কিছু অসাধু ব্যক্তি এবং চক্র এই দুঃখজনক ঘটনার সুযোগ নিয়ে সমাজে ভ্রান্ত তথ্য ছড়াচ্ছে। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দোকান ও জনবহুল স্থানে গিয়ে মানুষের সহানুভূতি আদায়ের নামে ভুয়া অনুদান সংগ্রহ করছে। তারা বলছে, এই মেয়েটির দুই সন্তান এতিম হয়ে গেছে, তাদের সাহায্য করুন। এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে প্রচারিত।’
তিনি বলেন, ‘জ্যোতির আমরা দুইজন ভাই আছি। আমরা দুইজনই আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। আমার বোন ২০১৮ সালে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ করেছিলেন। তখন জমজ ছেলে দুইটার বয়স মাত্র এক বছর। তারপর থেকে একাই দুই সন্তানকে বড় করেছেন। বাচ্চাদের বয়স এখন আট বছর। আমার বোন উচ্চ শিক্ষিত নারী ছিলেন। ঢাকায় একটি কোম্পানির এনএসএম হিসেবে কাজ করতেন। প্রায় ৭০ হাজার টাকার কাছাকাছি বেতন পেতেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জন্য লড়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাই আমাদের পরিবার কারো সহানুভূতির বা অর্থনৈতিক সহায়তার প্রয়োজন অনুভব করছেনা। অনুগ্রহ করে কেউ এসব কথায় প্ররোচিত হয়ে অর্থ প্রদান করবেন না। সিটি কর্পোরেশন এবং কয়েকটি সংগঠন থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে আমরা একই কথা আগেই বলেছিলাম। এমনকি গত ২৯ জুলাই যেদিন আমার বোনের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়, সেদিনই অর্থ সহায়তা নিবো না বলে সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়ে আসি।’
আরও পড়ুন: ৩৭ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযান, ম্যানহোলে পড়ে নিখোঁজ তাসনিমের মরদেহ মিলল বিলে
বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিবারের সদস্যদের সিদ্ধান্তের কথা বলে জ্যোতির বড় ভাই হাসানুজ্জামান লোটন আরও বলেন, ‘আমার দুই ভাগ্নে আমাদের কলিজার টুকরো। এখন আমাদের বোন আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আমরা চাইনা তার সন্তানরা যেন বাবার ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত হয়। একজন সন্তানের কাছে মা ও বাবা উভয়ের ভালোবাসা সবচেয়ে মূল্যবান। তারা তাদের মা কে হারিয়েছে, বাচ্চা দুইজন বাবা কেউ হারাই ফেলুক এটা আমাদের পরিবার চাইনি। আমরা পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাচ্চারা তাদের বাবার কাছে থাকবে। তাদের দাদি, বাবা এবং মামারা সবাই মিলে সন্তানদের মানুষ করবে, ইনশাআল্লাহ। আমার বোনের সমস্ত সম্পত্তি বাচ্চাদের নামে হস্তান্তর করা হবে। বাসা ও দোকান ভাড়ার টাকা প্রতি মাসে তাদের নামে ব্যাংকে জমা হবে। ইতোমধ্যেই বোনের গহনা থেকে শুরু করে মূল্যবান সবকিছুই আমরা ব্যাংকে ওই বাচ্চাদের নামে জমা রেখেছি।। বাচ্চা প্রাপ্তবয়স্ক হলে এই টাকা ব্যবহার করতে পারবে। আমরা চাইনা, এই দুই বাচ্চার আর কোনো শূন্যতা থাকুক।’
জ্যোতির ছোট ভাই আকরামুজ্জামান শোভন বলেন, ‘আমরা আমাদের বোনের কলিজার টুকরোকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলবো। তাঁদেরকে মানুষের মতো মানুষ করতে আমরা দুই ভাই এবং আমাদের সন্তানরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের বোন তার দুই সন্তানকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন। মা হারা ওই শিশু দুইটির দিকে তাকালে হৃদয় ফেটে যায়। আর যাইহোক আমরা চাই শিশু দুইটা তাঁদের পিতার স্নেহ যেন পাই। তবে আমাদের কোনো আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন নেই।