মুশফিক আমাদের ‘মিস্টার ক্রিকেট’

১ সপ্তাহে আগে
টেস্ট স্টেটাস পাওয়ার পর ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক বাংলাদেশের। চলতি বছর টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের রৌপ্য জয়ন্তী পালন করেছে বাংলাদেশ। উপলক্ষ্যটা আরও রঙিন হয়ে উঠেছে মুশফিকুর রহিমের জন্য। টাইগার ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শততম টেস্ট খেলার দ্বারপ্রান্তে মুশফিক। সিলেটে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টটি ছিল তার ক্যারিয়ারের ৯৯তম টেস্ট। ঢাকার হোম অব ক্রিকেটে আগামীকাল (১৯ নভেম্বর) এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছে দেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।

আইসিসির দশম পূর্ণ সদস্য হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে পথচলা শুরু বাংলাদেশের। ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণে ২৫ বছর কাটিয়ে ফেললেও অর্জনের খাতায় খুব বেশি দাগ কাটতে পারেনি টাইগাররা। এই দীর্ঘ সময়ে দেশের একজন ক্রিকেটারও ১০০ টেস্ট খেলতে পারেননি। বাংলাদেশের আগে টেস্ট খেলা শুরু করা দলগুলোর মধ্যে শুধু জিম্বাবুয়েরই কোনো ক্রিকেটারের নেই এই অর্জন।


অবশ্য এর দায় পুরোপুরি বর্তায় আইসিসির ওপর। বাংলাদেশ প্রতি মৌসুমে টেস্ট খেলার সুযোগই পেয়েছে তুলনামূলক কম। যে কারণেন স্টিভ স্মিথ, জো রুট বা বিরাট কোহলিরা অনেক পরে এসেও ১০০'র বেশি টেস্ট খেলে ফেললেও সেই মাইলফলক ছুঁতে মুশফিককে খেলতে হলো ২০ বছরের বেশি সময়।


বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার মুশফিকের শততম টেস্টের আগে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তার বর্তমান ও সাবেক সতীর্থ ও কোচরা। করছেন স্মৃতিচারণা। ইএসপিএন-ক্রিকইনফো'কে তাদের দেয়া সেইসব বক্তব্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো–


তামিম ইকবাল (সাবেক অধিনায়ক)


 

খেলার প্রতি নিবেদন মুশফিককে করে তুলেছে পরিশ্রমী। ছবি: পিটিআই


মুশফিকের জন্য এটি এক বিশাল অর্জন। তিনি এমন একজন, যিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের হয়ে ১০০ টেস্ট খেলার যোগ্য। অনেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার আছেন, যারা তার পরে অভিষেক করেও শতাধিক টেস্ট খেলে অবসরে গেছেন। এমন সময়ও ছিল যখন বাংলাদেশ দুই বছরের বেশি সময়েও কয়েকটি টেস্ট ম্যাচ খেলত কেবল।


আরও পড়ুন: আফগানিস্তানকে হেসেখেলে হারিয়ে সেমিতে এক পা বাংলাদেশের


দীর্ঘ ক্যারিয়ার ছাড়া এতগুলো টেস্ট খেলা সম্ভব নয়। পাশাপাশি দরকার ছিল শৃঙ্খলা, পরিশ্রম এবং দূরদৃষ্টি। এই অর্জন দেশের প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীর উদযাপন করা উচিত। পুরো টেস্ট ম্যাচজুড়ে মুশফিককে প্রশংসা ও উদযাপন করা উচিত। তিনি এই ম্যাচে ২০ রান করুন বা ২০০—কোনো বিচার হওয়া উচিত নয়।


আমি তার সঙ্গে ১৭-১৮ বছর খেলেছি। তাকে বড় রান করতে দেখেছি, কিন্তু কখনো দীর্ঘ ইনিংস খেলে তাকে ক্লান্ত হতে দেখিনি। অন্য ক্রিকেটারদের বড় সেঞ্চুরির পর ক্লান্ত হতে দেখেছি, কিন্তু মুশফিককে না। তার প্রস্তুতি, তার ক্ষুধা—এটা হয় জন্মগত, নয়তো সে নিজে তা তৈরি করেছে। আমার মনে হয় তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচেও এই ক্ষুধা থাকবে।


মুমিনুল হক (সাবেক অধিনায়ক)


আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না, বাংলাদেশের কারও ক্যারিয়ার ২০ বছর পর্যন্ত টিকে গেছে এবং সে ১০০ টেস্ট পূরণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমন এক কিংবদন্তির সঙ্গে এত বছর ড্রেসিং রুম শেয়ার করতে পারা সত্যিই সৌভাগ্যের।


কখনও মনে হয়, তার জীবনটা খুবই ‘বোরিং’। একজন মানুষ কীভাবে এত শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং ক্রিকেটে এত নিবেদিত হতে পারে! আমরা কখনো তার মতো হতে পারিনি। মাঠের বাইরে তিনি খুব শান্ত। খাবার, ঘুম—সবকিছুতেই তিনি শৃঙ্খলাবদ্ধ। আমার মনে হয় না আমরা ভবিষ্যতে তার মতো এত নিবেদিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ কাউকে পাবো।

 

Mushfiqur Rahim took Bangladesh to victory along with Shakib Al Hasan, Pakistan vs Bangladesh, 2nd Test, Rawalpindi, 5th day, September 3, 2024সতীর্থদের কাছে মুশফিক মানেই নির্ভরতা। ছবি: এপি


তিনি ছোট ছোট অনেক কিছুই অসাধারণভাবে করেন। তিনি খুব প্রোঅ্যাকটিভ। খুব সংগঠিত। খুব নির্দিষ্টভাবে অনুশীলন করেন। মুশফিক ভাই জানেন তিনি কী চান। এই সিরিজ শেষ হলেই আমি নিশ্চিত তিনি পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণ নিয়ে কাজ শুরু করবেন—যদিও সেটা তিন মাস পরের বিষয়। বড় খেলোয়াড়রা এভাবেই আগে থেকেই পরিকল্পনা করে। তার খুঁটিনাটির প্রতি মনোযোগ অসাধারণ।


আরও পড়ুন: ওয়ানডে সিরিজ থেকে ছিটকে গেলেন মিচেল

 

ডেভ হোয়াটমোর (বাংলাদেশের সাবেক কোচ)


মুশফিক এমন একজন, যিনি ঠিক জানতেন তিনি কী অর্জন করতে চান এবং নিজের প্রেরণা ও শৃঙ্খলার জোরে তা অর্জন করেছেন। তাকে সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকতে দেখে আমি খুবই খুশি—উত্থান-পতন, ইনজুরি—সবকিছু সামলে। ২০০৭ সালে আমি যাওয়ার পরও মাঝে মাঝে তার ক্যারিয়ার অনুসরণ করেছি। সাকিব (আল হাসান) এবং পরে তামিম (ইকবাল)-এর সঙ্গে তিনি দেশকে গর্বিত করেছেন। ওয়ানডেতেও দারুণ করেছেন। তার স্লগ-সুইপ তো কিংবদন্তি!'


 

Mushfiqur Rahim completed his 11th Test century, Pakistan vs Bangladesh, 1st Test, day 4, Rawalpindi, August 24, 2024দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ডাবল সেঞ্চুরির মালিক মুশফিক। ছবি: এপি


চন্ডিকা হাথুরুসিংহে (বাংলাদেশের সাবেক কোচ)


মুশফিকুর রহিম যখন তার ১০০তম টেস্ট খেলতে মাঠে নামছেন, তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট উদযাপন করছে শুধু একটি মাইলফলক নয়, বরং এমন একজন মানুষকে যার প্রভাব পরিসংখ্যানের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি বাংলাদেশ দলের দুই ভিন্ন সময়ে মুশফিককে কোচিং করানোর সুযোগ পেয়েছি—প্রথমে ২০১৪ থেকে ২০১৭, আর পরে ২০২৩ থেকে ২০২৪। এবং যা কখনও বদলায়নি, তা হলো তার পেশাদারিত্ব, প্রতিশ্রুতি ও নেতৃত্ব।


মুশফিক বিশ্বের অন্যতম শৃঙ্খলাবদ্ধ ক্রিকেটার। তার প্রস্তুতি বিশ্বমানের—নিয়ন্ত্রিত, নিয়মিত এবং প্রতিদিন একই রকম নিবেদিত। মিরপুরে হোক বা বিদেশে—কখনো মান কমতে দেন না। আগে আসেন, কন্ডিশন বোঝেন, প্রতিটি সেশন যাতে উদ্দেশ্যমূলক হয় তা নিশ্চিত করেন। তরুণদের জন্য তাকে দেখা মানেই শেখা।


টেকনিক, মানসিক দৃঢ়তার বাইরে তার চরিত্র সবচেয়ে নজরকাড়া। তিনি সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও সৎ নেতাদের একজন, যাদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। তিনি দলীয় সংস্কৃতি তৈরি করেন। কথার চেয়ে কাজে নেতৃত্ব দেন। তিনি কথা বললে সবাই শোনে—জ্যেষ্ঠতা বলে নয়, বরং সবাই জানে তিনি দলের মঙ্গলেই বলেন।


 

২০১৩ সালে গলে দেশের পক্ষে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান মুশফিক। সেই টেস্টে আশরাফুলের সঙ্গে ২৬৭ রানের জুটি গড়েন এই সাবেক অধিনায়ক। ছবি: এপি


১০০ টেস্ট যেকোনো ক্রিকেটারের জন্য বিশাল অর্জন। কিন্তু মুশফিকের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ কিছু—কারণ তিনি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন গর্ব, শৃঙ্খলা ও বিনয়ে। তার যাত্রা প্রতিভার চেয়ে বেশি—এটি কঠোর পরিশ্রম ও খেলাটির প্রতি গভীর ভালোবাসার গল্প।


এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তাকে অভিনন্দন জানাই—শুধু সাবেক কোচ হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে যে তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে। বাংলাদেশ ক্রিকেট তার কারণে সমৃদ্ধ হয়েছে, এবং তার উত্তরাধিকার আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। অভিনন্দন, মুশফিক। তুমি এই মুহূর্তটির পূর্ণ যোগ্য।


আরও পড়ুন: মুশফিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ আয়ারল্যান্ডের কোচ


হাবিবুল বাশার (সাবেক অধিনায়ক)


তিনি সত্যিকারের কিংবদন্তি। মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে আমি সত্যিই, সত্যিই গর্বিত। তিনি দুর্দান্ত কাজ করেছেন। এটি এক বিশাল ব্যাপার। শততম টেস্ট খেলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পারফর্ম করতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। একসময় আসে যখন মন চায় না, শরীর চায় না। মনে হয়—‘আর পারছি না’। কিন্তু ‘আর পারছি না’—এই বাক্যটি মুশফিকুর রহিমের অভিধানে নেই। তিনি আমাদের মিস্টার ক্রিকেট, আমাদের মাইক হাসি।


আরেকটি বিষয় হলো—বাংলাদেশ ইংল্যান্ড, ভারত বা অস্ট্রেলিয়ার মতো এত টেস্ট খেলে না। এত কম সুযোগের মধ্যেও তার মনোবল, নিবেদন টিকিয়ে রাখা—এটাই বিশাল অর্জন। তার আবেগই তাকে বিশেষ করে তোলে। তাকে বাকিদের থেকে আলাদা করে। আমি চাই তিনি আরও অনেকদিন খেলুন।
 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন