মানুষের জিজ্ঞাসাবাদ কবরেই শুরু হয়ে যাবে। মুনকার ও নাকির নামের কালো বর্ণের নীল চোখবিশিষ্ট দুজন ফেরেশতা এসে কবরস্থ মানুষকে জিজ্ঞেস করবেন তার প্রতিপালক, দ্বীন ও নবী সম্পর্কে। নেককার ব্যক্তি সঠিক উত্তর দিতে পারবেন কিন্তু বদকার ও মুনাফিক ব্যক্তি যথাযথ উত্তর দিতে পারবে না।
মুনকার নাকির কবরবাসীকে যে তিনটি প্রশ্ন করবেন
মানুষ মারা যাওয়ার পর তাকে যখন কবরস্থ করা হয় এবং দাফন শেষে সবাই ফিরে যায়, তখন ফেরেশতাদ্বয় মুনকার ও নাকির এসে হাজির হন। হাদিসে এসেছে, রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
যখন মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করা হয় আর মানুষ তার কাছ থেকে সরে যায়, এমনকি সে তাদের জুতার শব্দও শুনতে পায়, তখন তার কাছে দুজন ফেরেশতা আসে। তাকে বসিয়ে প্রশ্ন করে। (বুখারি: ১৩৩৮)
যে দু’জন ফেরেশতা তার কাছে আসবে তাদের দুই জনের একজনের নাম মুনকার আর অপর জনের নাম নাকির।
১. مَنْ رَبُّكَ ‘মান রাব্বুকা’ অর্থ: ‘তোমার রব কে?’ তখন মুমিন ব্যক্তি উত্তরে বলবে رَبِّيَ اللَّهُ ‘রাব্বী আল্লাহ’ অর্থ: ‘আমার রব আল্লাহ’। ২. مَا دِينُكَ ‘মা দ্বীনুকা’ অর্থ: ‘তোমার দ্বীন কী?’ উত্তরে সে বলবে- دِينِي الإِسْلاَمُ ‘দ্বীনি আল-ইসলাম’ অর্থ: ‘আমার দ্বীন হলো ইসলাম’।
৩. مَا هَذَا الرَّجُلُ الَّذِي بُعِثَ فِيكُمْ ‘মা হাজার রাজুলুল্লাজী বুঈসা ফীকুম’ অর্থ: ‘এ লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে?’ সে উত্তরে বলবে-هُوَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‘হুয়া রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ অর্থ: তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’।
৪. وَمَا يُدْرِيكَ ‘ওয়ামা ইয়ুদরীকা’ অর্থ: ‘তুমি কীভাবে জানলে?’ উত্তরে সে বলবে- قَرَأْتُ كِتَابَ اللَّهِ فَآمَنْتُ بِهِ وَصَدَّقْتُ ‘ক্বারা’তু কিতাবাল্লাহি ফাআমানতু বিহি ওয়াসাদ্দাকতু’ অর্থ: ‘আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি এবং তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করেছি।’
মুনকার-নাকিরে প্রশ্নের উত্তরে কাফির-মুনাফিক যা বলবে
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বদকার ব্যক্তি বলবে- هَاهْ هَاهْ هَاهْ لاَ أَدْرِي ‘হাহ হাহ হাহ লা আদরী’ অর্থ: ‘হায় আমি কিছুই জানি না’। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বদকার ব্যক্তি বলবে- هَاهْ هَاهْ لاَ أَدْرِي ‘হাহ হাহ লা আদরী’ অর্থ: ‘হায় আমি কিছুই জানি না’। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে বদকার ব্যক্তি বলবে- هَاهْ هَاهْ لاَ أَدْرِي ‘হাহ হাহ লা আদরী’ অর্থ: হায় আমি কিছুই জানি না’।
প্রশ্নোত্তর পর্বশেষে নেককার বান্দাকে বলা হবে- আপনি সত্য বলেছেন। অতঃপর তার কবর ৭০ গজ প্রশস্ত হয়ে যাবে। কবরে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। তাকে এমন শান্তির ঘুম পাড়ানো হবে কেয়ামতের আগে তার ঘুম ভাঙবে না। অন্য বর্ণনামতে, তার জন্য জান্নাতের একটি বিছানা বিছিয়ে দেওয়া হবে, জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দেওয়া হবে এবং তার জন্য জান্নাতের দিকে একটা দরজা খুলে দেওয়া হবে। ফলে তার দিকে জান্নাতের স্নিগ্ধকর হাওয়া ও সুগন্ধি বইতে থাকবে। ওই দরজা তার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করা হবে।
আরও পড়ুন: নবীজির প্রিয় ও পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে সিরাতের বই ‘নবীজির প্রিয় ১০০’
আর বদকার বান্দাকে বলা হবে- তুই মিথ্যা বলেছিস। অতঃপর মাটি তাকে এমন শক্তভাবে চাপ দেবে যে, তার পাঁজরের হাড়গুলো একটির মধ্যে আরেকটি ঢুকে পড়বে। কেয়ামত পর্যন্ত সে এভাবেই শাস্তি পেতে থাকবে।
অন্য বর্ণনামতে, তার জন্য জাহান্নামের একটি বিছানা বিছিয়ে দেওয়া হবে, তাকে জাহান্নামের পোশাক পরানো হবে এবং তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটা দরজা খুলে দেওয়া হবে। ফলে তার দিকে জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস আসতে থাকে।
এছাড়াও তার জন্য এক অন্ধ ও বধির ফেরেশতাকে নিযুক্ত করা হবে, যার সঙ্গে একটি লোহার হাতুড়ী থাকবে। বর্ণনামতে, যদি এই হাতুড়ি দিয়ে পাহাড়কে আঘাত করা হয় তাহলে তা ধূলায় পরিণত হয়ে যাবে। কবরে বদকার ব্যক্তি ফেরেশতার হাতুড়ির আঘাতে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকে যা মানুষ ও জ্বিন ছাড়া পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত সকল সৃষ্টি জীব শুনতে পায়। আঘাতের ফলে সে মাটিতে মিশে যায়। অতঃপর (শাস্তি অব্যাহত রাখার জন্য) পুনরায় তাতে রুহ ফেরত দেয়া হয়। (তিরমিজি: ১০৭১, সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৫৩)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের মধ্যে কোনো মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হয় তখন কালো ও নীল বর্ণের দু’জন ফিরিশতা আগমন করে। একজনের নাম মুনকার অন্যজনের নাম হলো নাকীর। তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমরা কী বলতে? সে বলবে, সে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। তখন ফিরিশতাদ্বয় বলবে, আমরা আগেই জানতাম তুমি এ উত্তরই দিবে। এরপর তার কবরকে সত্তর হাত প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। সেখানে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তাকে বলা হয়, এখন তুমি নিদ্রা যাও। সে বলবে, আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবো, তাদেরকে (আমার অবস্থা সম্পর্কে) এ সংবাদ দেব।
তখন ফিরিশতাদ্বয় তাকে বলে, তুমি ঘুমাও সেই নব বধুর মত যাকে তার প্রিয়জন ব্যতীত কেউ জাগ্রত করে না। এমনিভাবে একদিন আল্লাহ তাকে জাগ্রত করবেন। আর যদি সে ব্যক্তি মুনাফেক হয়, সে উত্তর দিবে আমি তার (রসুলুল্লাহ) সম্পর্কে মানুষকে যা বলতে শুনেছি তাই বলতাম। বাস্তব অবস্থা আমি জানি না। তাকে ফেরেশ্তাদ্বয় বলবে, আমরা জানতাম, তুমি এই উত্তরই দিবে।
তখন মাটিকে বলা হবে তার উপর চাপ সৃষ্টি করো। মাটি এমন চাপ সৃষ্টি করবে যে, তার হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। কিয়ামত সংঘটনের সময় তার উত্থান পর্যন্ত এ শাস্তি অব্যাহত থাকবে। (তিরমিজি: ১০৭১)
ঈমানদার ব্যক্তি বরযখের জীবনে সুখ-নিদ্রায় বিভোর থাকবে। যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে তখন তার নিদ্রা ভেঙ্গে যাবে ফলে সে অনেকটা বিরক্তির স্বরে বলবে:
قَالُواْ يَٰوَيۡلَنَا مَنۢ بَعَثَنَا مِن مَّرۡقَدِنَاۜ ۗ هَٰذَا مَا وَعَدَ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَصَدَقَ ٱلۡمُرۡسَلُونَ হায়! কে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠালো? (তাদের বলা হবে) এটা তো সে জিনিস যার ওয়াদা পরম করুণাময় করেছিলেন এবং রসুলগণ সত্য বলেছিলেন। (সুরা ইয়াসিন: ৫২)
বরযখের জীবন আসলে আখিরাতের প্রস্তুতির ক্ষেত্র। এখানে মুনকার ও নাকিরের প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করে দেবে, সামনে আমাদের জন্য কোন দরজা খুলবে, জান্নাতের না জাহান্নামের। এজন্য দুনিয়াতে জীবিত অবস্থায় ঈমানকে দৃঢ় করা এবং সঠিক আমল করা অত্যন্ত জরুরি। কবরের অন্ধকারে কাউকে সাহায্য করবে না আমাদের সম্পদ, মর্যাদা বা পরিবার-পরিজন। তখন সহায়ক হবে শুধু সঠিক আকিদা, নেক আমল, কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা।
মুমিন ব্যক্তি যদি দুনিয়াতে আল্লাহকে এক রব হিসেবে মানে, ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে শেষ নবী হিসেবে মেনে চলে, তবে কবর তার জন্য জান্নাতের বাগান হয়ে উঠবে। পক্ষান্তরে কাফির ও মুনাফিকের জন্য কবর হবে জাহান্নামের খাদ।
তাই আমাদের করণীয় হলো, আজই নিজেদের ঈমান-আমল যাচাই করা, কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করা, এবং কবরের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রস্তুত হওয়া। কারণ মৃত্যু হঠাৎ করেই আসবে, আর তখন আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
]]>