মানববর্জ্যের সারে সোনার ফসল, কৃষকের মুখে হাসি

৭ ঘন্টা আগে
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে চাষাবাদ হয়েছে ধানের। থোকায় থোকায় ধরেছে বেগুন, টমেটোসহ বিভিন্ন ফসল। বাম্পার ফলনে খুশি চাষিরা। তবে এসব ফলন চাষাবাদে ব্যবহার হয়নি প্রচলিত রাসায়নিক সার। এর বদলে প্রয়োগ করা হয়েছে মানববর্জ্য থেকে উৎপাদিত জৈব সার।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ও গোবরাতলা ইউনিয়ন। এখানকার ২০০টি পরিবার ইকো টয়লেট ব্যবহার করে মানববর্জ্য থেকে এসব জৈব সার উৎপাদন করে ব্যবহার করছেন। জানা যায়, ২০১১ সাল থেকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোসাইটি ফর পিপলস অ্যাকশন ইন চেঞ্জ অ্যান্ড ইকুইটি-স্পেস'র সহযোগিতায় এসব টয়লেট স্থাপন ও ব্যবহার করছেন কৃষকরা।

 

তাদের দাবি, এই সার ব্যবহারে কমেছে উৎপাদন খরচ, অন্যদিকে বেড়েছে লাভ। এমনকি উৎপাদনের পরিমাণও বেড়েছে জমিতে জৈব সার ব্যবহারে। ফলে দিন দিন বাড়ছে ইকো টয়লেট ব্যবহার করে মানববর্জ্য থেকে জৈব সার ব্যবহার।

 

আরও পড়ুন: দিনাজপুর / বোরো ধানে মাজরা পোকার হানা, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় চাষিরা

 

দুই ইউনিয়নে গত ১০ বছর ধরে তারা ইকো টয়লেটের মাধ্যমে মানববর্জ্য থেকে তৈরি সার ব্যবহার করছেন ধান, গম, টমেটো, আলুসহ অন্যান্য ফসলে। উৎপাদন খরচ কম হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব উপায় হওয়ায় লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। রাসায়নিক সারের বদলে জৈব সার ব্যবহারে বাম্পার ফলনে খুশি তারা। পরিবেশ বান্ধব উপায় হওয়ায় ইকো টয়লেট ব্যবহার করে জৈব সার উৎপাদন বাড়াতে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা নেয়ার দাবি বিশেষজ্ঞ ও কৃষকদের।

 

কৃষকরা জানান, ইকো টয়লেটের প্রসব নিদিষ্ট পাত্রে ধরে ব্যবহার করা যায় জমিতে। যা ইউরিয়া, ফসফেট, পটাশের কাজ করে। পাশাপাশি জমির উর্বরতাও বাড়ায় এই সার। ক্ষতিকর দিক না থাকায় ও লাভবান হওয়ায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও কৃষকদের মাঝে ইকো টয়লেট ব্যবহার বাড়ছে।

 

সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের পলশা গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, এই এলাকায় আমি সর্বপ্রথম ইকো টয়লেট ব্যবহার করে জৈব স্যার তৈরি করে তা ব্যবহার শুরু করেছিলাম। সেসময় লোকজন আমাকে নানা রকম উল্টাপাল্টা কথা বলেছিল, হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছিল। কিন্তু কয়েক মাস পরেই আমার ফসলের উৎপাদন দেখে অবাক হয়েছিল স্থানীয় কৃষকরা। এরপর ধীরে ধীরে তারাও একই পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করে। এখন এই এলাকায় ইকো টয়লেট থেকে তৈরি জৈব সার নেয়ার জন্য কৃষকরা আগাম বুকিং দিয়ে রাখে।

 

ইকো টয়লেট ব্যবহারকারী নারী তাসলিমা বেগম জানান, প্রথম দিকে এটি ব্যবহারের কথা ভাবলেই কেমন জানি একটা অস্বস্তি লাগতো। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। কোনোরকম গন্ধ ছড়ায় না পরিবেশে।  টয়লেটের দুটি চেম্বার থাকে। ছয় মাস অন্তর অন্তর সেসব সার উত্তোলন করে জমিতে ব্যবহার করা যায়।

 

ইকো টয়লেট। ছবি: সময় সংবাদ

 

কৃষক ইসমাইল হোসেন বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে ইকো টয়লেটের জৈব সার ব্যবহারের পর বাম্পার ফলন পেয়েছি। এরপর থেকে আর কখনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করিনি। উচ্চ মূল্য দিয়ে কিনে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে যে ফলন পাওয়া যায়, ইকো টয়লেটের জৈব সারে তার থেকে বেশি ফলন পাওয়া যাচ্ছে। এতে আমাদের খরচ কমছে, লাভের পরিমাণ বাড়ছে।

 

আনারুল ইসলাম নামের এক চাষিরা জানান, আমি আম বাগানে ইকো টয়লেটের জৈব সার ব্যবহার করেছিলাম। গাছে ঝরে পড়া এসব গাছে ব্যবহারের পর নতুন পাতা আসে। টানা কয়েক বছর এই সার ব্যবহার করে ফলন বাম্পার পেয়েছি।

 

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোসাইটি ফর পিপলস অ্যাকশন ইন চেঞ্জ অ্যান্ড ইকুইটি-স্পেস'র প্রজেক্ট ম্যানেজার শাজাহান আলী জানান, বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার ঝিলিম ও বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের ২০০টি পরিবারের মাঝে ইকো টয়লেট ব্যবহার হচ্ছে। এর চাহিদাকে বিবেচনা করে এর পরিমাণ আরো বাড়ানো হবে। বর্তমানে অনেক কৃষকই ইকো টয়লেটে জৈব সার ব্যবহার করছেন। এমনকি এই এলাকার কৃষকদের মাঝে এই জৈব সার ব্যবহারের আগ্রহ বেড়েছে।

 

ইকো টয়লেট থেকে জৈব সার উৎপাদন ও জমিতে এর ব্যবহার দেখতে সরেজমিনে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম। পরিদর্শন শেষে তিনি জানান, বিশ্বের উন্নত বেশ কিছু দেশে আমি ভ্রমণ করেছি। এসব দেশের সুপার মার্কেটগুলোতে জৈব সার অর্থাৎ অর্গানিক উপায়ে উৎপাদিত ফসল ও রাসায়নিক সারে উৎপাদিত ফসল আলাদা করে রাখা হয়, এমনকি এর দামের মধ্যেও পার্থক্য আছে। তাই বাংলাদেশে এর পরিমাণ বাড়াতে পারলে কৃষিতে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব।

 

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও জমির গুণগত মান ঠিক রাখতে ইকো টয়লেটের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহারের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এফএম আলী হায়দার। তিনি জানান, রাসায়নিক সার আমদানি করতে গিয়ে প্রতিবছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। জনবহুল এই দেশে ইকো টয়লেটের ব্যবহার বৃদ্ধি করলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ঘটবে। পাশাপাশি জমির গুণগত মান বজায় রাখতে ও উর্বরতা বাড়াতে জৈব সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায় হতে পারে ইকো টয়লেট ব্যবহারের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন ও জমিতে ব্যবহার।

 

আরও পড়ুন: বৈরী আবহে ফসলে চিটা, কষ্টের ধানেও লাভের আশা ক্ষীণ

 

পরিবেশ অধিদফতরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আবু সাইদ বলেন, ইকো টয়লেট ব্যবহারের পর সেখানকার মানববর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন পরিবেশবান্ধব। এর পরিমাণ যত বৃদ্ধি ঘটবে, ততই নিরাপদ খাদ উৎপাদন নিশ্চিত হবে।

 

প্রসঙ্গত, একেকটি ইকো টয়লেট থেকে বছরে ১৫০ কেজি জৈব সার উৎপাদন করা যায়। যা এক বিঘা জমিতে ব্যবহার করা যায়। এতে বিঘাপ্রতি সাশ্রয় হয় ২-৩ হাজার টাকা।

 

চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমারক ও দক্ষিণ শহর এলাকায় ইকো টয়লেট ও সেখানকার মানববর্জ্য থেকে তৈরি জৈব সার উৎপাদন ও ফসলে ব্যবহারের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করেছেন জাপানের নিষ্কাশন ও পরিবেশ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপার্সন ড. আকিরা সাকাই। এসময় তিনি ইকো টয়লেটের ব্যবহার, সেখানকার মানববর্জ্য থেকে তৈরি জৈব সার বিভিন্ন ফসলি জমিতে ব্যবহারের কার্যক্রম দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। পাশাপাশি উপকারভোগী, স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে উঠান বৈঠক করেন ড. আকিরা সাকাই।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন