মসজিদে নববির ভিত্তি: ঈমান, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের নতুন সূচনা

৩ সপ্তাহ আগে
৬২২ খ্রিস্টাব্দ। মদিনার আকাশে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। মক্কায় দীর্ঘ নির্যাতন, অবরোধ, হত্যাযজ্ঞ এবং অবিশ্বাসীদের চরম নির্যাতনের পর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার প্রিয় সাহাবিরা মদিনায় হিজরত করলেন।

হিজরতের এই মুহূর্ত কেবল একটি ভৌগোলিক স্থানান্তর ছিল না,বরং এটি ছিল ঈমান, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের নতুন সূচনা। মদিনায় পৌঁছানোর পর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম যে কাজটি করলেন, তা হলো ইসলামের কেন্দ্রস্থল,মসজিদে নববি,এর ভিত্তি স্থাপন। এটি শুধু নামাজের জায়গা ছিল না; বরং এখানেই শুরু হয়েছিল ইসলামি সভ্যতা, সামাজিক বন্ধন এবং উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের ইতিহাস।

 

মসজিদে নববির ভিত্তি: ইসলামি সমাজের হৃদয়স্থল

 

মদিনায় পৌঁছানোর পর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বানু নাজ্জারের এলাকায় উটের হাল্টে থামলেন। উটটি যেখানে বসে গেল, সেই জমিই হলো ভবিষ্যতের মসজিদে নববি। জমির মালিকরা অনাথ বাচ্চারা ছিল। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিনিময়ে জমির দাম পরিশোধ করলেন এবং সাহাবিদের নিয়ে স্বয়ং নিজে মাটি কাটতে, ইট বহন করতে এবং দেয়াল তুলতে লাগলেন।


كَانَ يَنْقُلُ مَعَهُمُ اللَّبِنَ، وَهُوَ يَقُولُ: اللَّهُمَّ لَا عَيْشَ إِلَّا عَيْشُ الآخِرَةِ، فَاغْفِرْ لِلْأَنْصَارِ وَالْمُهَاجِرَةِ রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের সাথে ইট বহন করছিলেন এবং বলছিলেন, হে আল্লাহ! প্রকৃত জীবন তো আখিরাতের জীবন। অতএব আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করুন। সাহাবিদের সাথে ইট বহন করছিলেন এবং বলছিলেন, হে আল্লাহ! প্রকৃত জীবন তো আখিরাতের জীবন। অতএব আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করুন। (সহিহ বুখারি:৪২৮) মসজিদে নববি ছিল কেবল ইবাদতের স্থান নয়, বরং ইসলামের ইতিহাসে এটি হয়ে ওঠে জ্ঞান, শাসন, ন্যায়বিচার, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু।

 

আরও পড়ুন: স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর আচরণ কেমন হবে?

 

মুহাজির ও আনসারদের ভ্রাতৃত্ব: ইসলামি ঐক্যের সোনালি অধ্যায়

 

মসজিদে নববির ভিত্তি স্থাপনের পর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরেকটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিলেন, মুহাজির (মক্কা থেকে আগত মুসলিম) ও আনসার (মদিনার মুসলিম) দের মাঝে ভ্রাতৃত্বের ঘোষণা দিলেন। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের জোড়ায় জোড়ায় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। যেমন, হজরত আবদুর রহমান ইবনু আওফ রা.-কে হজরত সাদ ইবনু রাবি রা.-এর ভাই বানালেন। সাদ রা. নিজের অর্ধেক সম্পদ এবং একটি বাগান পর্যন্ত ভাগ করে দেওয়ার প্রস্তাব করলেন,

 

কিন্তু আবদুর রহমান রা.বললেন, আল্লাহ আপনার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। আমাকে শুধু বাজারের রাস্তা দেখিয়ে দিন। (সহিহ বুখারি: ৩৭৮০) এই ভ্রাতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। এখানে কোনো স্বার্থ, লোভ বা প্রতিদান ছিল না, ছিল কেবল ঈমান, ভালোবাসা ও এক উম্মাহ হওয়ার স্বপ্ন।

 

আল্লাহ তাআলা এই ভ্রাতৃত্বের প্রশংসা করেছেন, وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا আর আল্লাহ তোমাদের হৃদয়গুলোর মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন;তার অনুগ্রহেই তোমরা ভাই হয়ে গিয়েছ। (সুরা আল ইমরান ১০৩)


 

মসজিদে নববি: ইসলামি সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু

 

মসজিদে নববি শুধু নামাজের স্থান ছিল না। এখানেই গড়ে উঠেছিল প্রথম ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানেই নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মাহকে তালিম দিতেন, বিচার কার্য পরিচালনা করতেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন।


১. এটি ছিল, ইবাদতের কেন্দ্র , সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও জিকির। ২.  জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, সহাবারা এখানে কুরআন ও হাদিস শিখতেন।৩.ঐক্যের কেন্দ্র, মুসলমানদের পরস্পর ভালোবাসা, সাহায্য ও সহযোগিতা ৪. শাসন ও ন্যায়বিচারের কেন্দ্র. এখান থেকেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয়েছিল।

 

মসজিদে নববির ভিত্তি স্থাপন ও মুহাজির-আনসারদের ভ্রাতৃত্ব আমাদের জন্য অমূল্য শিক্ষা রেখে গেছে, ১. ঐক্য ছাড়া উন্নতি নে , বিভক্ত উম্মাহ কখনো শক্তিশালী হতে পারে না।২.ভালোবাসা ও ত্যাগ , মুহাজির ও আনসারদের ত্যাগ আমাদের জন্য উদাহরণ।৩.মসজিদের কেন্দ্রীয়তা, মসজিদ কেবল নামাজের স্থান নয়, বরং মুসলিম জীবনের হৃদয়স্থল।৪.আল্লাহর পথে একত্রিত হওয়া, প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি একমাত্র ঈমান।


মসজিদে নববির ভিত্তি স্থাপনের সেই দিন থেকে শুরু হয়েছিল ঈমান, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের এক নতুন যুগ। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমাজ গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে কোনো ধনী-গরিব, কালো-সাদা, মুহাজির-আনসার ভেদাভেদ ছিল না, ছিল কেবল লাইলাহা ইল্লাল্লাহর পতাকাতলে একক উম্মাহ। আজ আমাদের দায়িত্ব হলো সেই আদর্শের দিকে ফিরে যাওয়া। মসজিদকে কেন্দ্র করে সমাজ পুনর্গঠন করা, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের সেই আলোকে আবার জ্বালিয়ে তোলা। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দিন। আমিন।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন