ময়মনসিংহে অনলাইন জুয়ার ফাঁদে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার, বাড়ছে প্রতারণাও

৪ সপ্তাহ আগে
ময়মনসিংহে অনলাইন জুয়ার ভয়াবহ নেশায় নিঃস্ব হয়ে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। শিক্ষার্থীসহ তরুণ সমাজ নানা চটকদার বিজ্ঞাপন ও দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভে প্রতিদিনই জড়িয়ে পড়ছে এই অনলাইন জুয়ার জালে। একইসঙ্গে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বাড়ি ভাড়া কিংবা বন্ধুত্বের ছলে ছড়িয়ে পড়ছে হানি ট্র্যাপসহ নানাধরনের প্রতারণা।

শখের বসে শুরু হওয়া অনলাইন জুয়া একসময় রূপ নিচ্ছে ভয়ানক আসক্তিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপন দেখে অনেক তরুণ-তরুণী অল্প সময়ে বেশি আয় করার আশায় পড়ছে এই ফাঁদে। শহর থেকে গ্রাম, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে এই নেশা। ফলে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবার, নষ্ট হচ্ছে তরুণদের ভবিষ্যৎ।


সম্প্রতি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার একটি গ্রামে গিয়ে কথা হয় অনার্স পড়ুয়া এক যুবকের সঙ্গে। দেড় বছর ধরে তিনি আসক্ত অনলাইন জুয়ায়। তিনি বলেন, 'বন্ধুদের দেখে ও পরে ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যুক্ত হই অনলাইন জুয়ায়। প্রথমে শখে খেললেও এখন এটি ছাড়া ঘুম আসে না। প্রায় ৮ লাখ টাকা ঋণ করেছি, জমি বিক্রি করে তা শোধ করতে হয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'আমার মতো একই অবস্থায় আছে গ্রামের আরও অনেক তরুণ।'


অনলাইন জুয়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অনেকে জড়িয়ে পড়ছে দাদন, চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে। গত ৮ অক্টোবর ময়মনসিংহের ত্রিশালের বৈলর বাঁশকুড়ি গ্রামে চাঞ্চল্যকর এক ঘটনা ঘটে। টাকা না পেয়ে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত এক যুবক নিজ বাবা-মাকে হত্যা করে নিজ বসত ঘরে মাটি চাপা দেয়। মর্মান্তিক এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছে গোটা দেশ।


তবে ময়মনসিংহে শুধু অনলাইন জুয়াই নয়, ফেসবুকভিত্তিক প্রতারণা চক্রের কার্যক্রমও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। বাড়ি ভাড়া দেওয়ার নাম করে কিংবা বন্ধুত্বের ছলে হানি ট্র্যাপে ফেলে প্রতারণার ঘটনা বেড়েই চলেছে।


ফেসবুকে ‘টু-লেট’ বিজ্ঞাপন দেখে ১১ সেপ্টেম্বর নগরের গুলকিবাড়ী এলাকার ফখরুজ্জামান টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় গিয়েছিলেন আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্র নাজমুল হাসান। সেখানে গিয়ে তিনি পড়েন প্রতারণার জালে। চার তরুণী ও চার তরুণ তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেন এবং মারধর করে সর্বস্ব লুটে নেন। পরে থানায় মামলা হলে পুলিশ সাদিয়া জাহান ওরফে মেঘলা ও ফারিয়া আক্তার ওরফে পায়েল নামের দুই তরুণীকে গ্রেফতার করে।


আরও পড়ুন: রংপুরে অনলাইন জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে যুবকের আত্মহত্যা


এর আগে ২ জুন মাসকান্দা এলাকা থেকে প্রাইভেটকার চালক স্বপন মিয়াকে চাকু ঠেকিয়ে অপহরণ করা হয়। তাকে নগরের আকুয়া গরুখোঁয়াড় মোড় এলাকার একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে এক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করা হয়। পরে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। স্বপন মিয়া স্ত্রীর মাধ্যমে বিকাশে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে মুক্তি পান। এ ঘটনায় থানায় ৪ জুন মামলা হলে পুলিশ জানায়, অভিযুক্তদের মধ্যে মো. নূর উদ্দিন আকন্দ (৩৮) ছিলেন মূলহোতা। আকুয়া এলাকায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি সিন্ডিকেট, যেটি মাদক ব্যবসা, অপহরণ, হানি ট্র্যাপসহ নানা অপরাধে সক্রিয় ছিল।


একই চক্রের নেতৃত্বে থাকা নূর উদ্দিন আকন্দের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে। ৮ এপ্রিল সিলেটের জকিগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ শহরে এসে অপহরণের শিকার হন জাকির হোসেন নামে এক ব্যক্তি। ৯ এপ্রিল থানায় করা মামলার ভিত্তিতে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ নূর উদ্দিনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায়। পরে ১৯ সেপ্টেম্বর তাকে দুই সহযোগীসহ গ্রেফতার করে পুলিশ।


এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ভার্চুয়াল জগতে নজরদারির অভাব, সহজ ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এবং অর্থের প্রলোভন- এই তিনটি প্রধান কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়া ও প্রতারণা।


আরও পড়ুন: দেনার চাপেই পরিবার নিয়ে পরপারে জুয়ায় আসক্ত মিনারুল!


সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে আকৃষ্ট করার বিষয়টি সকলের সামনেই ঘটছে। কিন্তু সরকার এখনো যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আর যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটি বিলম্বিত।'


তিনি আরও বলেন, 'এখনই কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সচেতনতা তৈরিতে একযোগে কাজ করতে হবে।'


ময়মনসিংহ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'আমরা প্রতারণার ঘটনাগুলোতে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনছি এবং অনলাইন জুয়া বন্ধে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছি। সেইসঙ্গে
গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।'

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন