আবার এমন কিছু মানুষও আমরা দেখেছি, যারা দূর থেকেই জুতাগুলো খুলে রেখে দেয়। বিনয় বিনম্রতার সাথে নিচের দিকে তাকিয়ে, প্রকম্পিত শরীরে, অশ্রু সজল নয়নে, ধীরগতিতে অপরাধীর ন্যায় সালাম পেশ করার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। রওজা মোবারকের পাশে দাঁড়িয়ে নিম্ন আওয়াজে আস সালামু আলাইকা ইয়া রসুলাল্লাহ বলে। আর তাদের চোখের নোনাজল গন্ডদেশ বেয়ে বুক আর মদীনার জমিনকে সিক্ত করে।
আরও পড়ুন: পুরুষদের আংটি পরা কি হারাম?
আমরা সবাই যাতে এরূপ অশ্রুসিক্ত বিনয়াবত সালাম পেশ করতে পারি তাই আমি পবিত্র মদিনার প্রিয় মুসাফির ভাই বোনদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা বলছি -
(এক) পূর্ণ সফরে ও মদিনা শরিফে অবস্থানের সময় মহব্বতের সাথে বেশি বেশি দরুদ শরীফ পাঠ করা। (দুই) মদিনা শরীফ পৌঁছে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হওয়া। অতঃপর আতর-সুগন্ধি লাগিয়ে আদবের সাথে মসজিদে উপস্থিত হওয়া। (তিন) মসজিদে প্রবেশের পর দুই রাকাত দুখূলুল মসজিদ নামাজ পড়া। (চার )খুবই আদবের সাথে সালাম দেওয়ার জন্য আগমন করা। অনুচ্চ আওয়াজে সালাম বলা।
প্রথমে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর শরীফে অতঃপর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাজি: অতঃপর হযরত ওমর রাজি: এর কবরে সালাম পেশ করা। সালাম পেশ করার সময় অনেক ভাই সেলফি তোলেন, ভিডিও ধারণ করেন, আবার কেউ লাইভ প্রচার করেন। আবার অনেকে উচ্চস্বরে কথা বলেন। আহ ! এগুলো কেন?
একবার চিন্তা করে দেখা দরকার কোথায় এসেছি? কার কবর মোবারকের সামনে এই গুনাহের কাজগুলো করছি? একটু তো লজ্জা হওয়া উচিত? (পাঁচ) জুতা স্যান্ডেল আস্তে রাখা।
অনেক ভাই মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় বিশেষত রওজা শরীফের আশেপাশের দরজা গুলো দিয়ে বের হওয়ার সময় এত জোরে জুতা স্যান্ডেল ফেলে থাকেন যার আওয়াজ দূর পর্যন্ত শোনা যায়।
একটু চিন্তা করে দেখেন তো পাশে কে শুয়ে আছেন? নিজের পীর, ওস্তাদ, অফিসার, বাবা-মা কিংবা মুহাব্বতের কেউ ঘুমিয়ে থাকলে আমরা কতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করি; কিন্তু মদিনা মুনাওয়ারার সম্মান কী এর চেয়েও অনেক বেশি নয়? তাই এখানে সবচেয়ে বেশি ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে।
(ছয়) নিম্নস্বরে কথা বলা। বিশেষত রওজা শরীফের আশেপাশে। চার,পাঁচ ও ছয় নম্বরে যে বিষয়গুলোর কথা হয়েছে সেগুলো এত ভয়াবহ অপরাধ যে, এগুলোর কারণে আমাদের সকল আমল অজান্তেই নিষ্ফল হয়ে যাবে। কেননা, আল্লাহ তায়ালার এরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَرۡفَعُوۡۤا اَصۡوَاتَکُمۡ فَوۡقَ صَوۡتِ النَّبِیِّ وَ لَا تَجۡہَرُوۡا لَہٗ بِالۡقَوۡلِ کَجَہۡرِ بَعۡضِکُمۡ لِبَعۡضٍ اَنۡ تَحۡبَطَ اَعۡمَالُکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَشۡعُرُوۡنَ হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চ স্বরে কথা বল, তার সাথে সেইভাবে উচ্চ স্বরে কথা বলো না; কারণ এতে অজ্ঞাতসারে তোমাদের আমল নিস্ফল হয়ে যাবে। (সূরা হুজুরাত, আয়াত নং ২)
আর এ আয়াতটি রওজা শরীফের উপরে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। অথচ আমাদের অনেক ভাই বোন এর প্রতি লক্ষ্য করেনা। যারা এগুলো করবে তাদের আমলসমূহ তাদের অজান্তে নিষ্ফল হয়ে যাবে। এ আয়াত এরই প্রমাণ বহন করে।
(সাত) মদীনা শরীফের সব কিছুকে ভালো ও মুহাব্বতের দৃষ্টিতে দেখা। (আট) ৪০ ওয়াক্ত নামাজ তাকবিরে উলার সাথে মসজিদে নববীতে পড়তে চেষ্টা করা।
জিয়ারাহ বা অন্য কোথাও গেলেও যেন মসজিদে নববীর জামাত ছুটে না যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
(নয়) জান্নাতুল বাকি (বাকীউল গরকদ কবরস্থানে) সকলের জন্য সালাম পেশ করা ও ঈসালে সওয়াব করা। (দশ) রিয়াজুল জান্নাহ প্রবেশের জন্য নিবন্ধন করা। সময় মত লাইনে দাঁড়িয়ে ধৈর্যের সাথে প্রবেশ করা।
(এগারো) সম্ভব হলে প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজের পর মসজিদে কুবায় গিয়ে ২-৪ রাকাত ইশরাকের নামাজ পড়া। দুই রিয়াল ভাড়ার বিনিময়ে গাড়িতে যাওয়া যায় কিংবা ইচ্ছা করলে ৩১০ নং গেট দিয়ে বের হয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কেননা, হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে-
مَنْ تَطَهَّرَ فِي بَيْتِهِ ثُمَّ أَتَى مَسْجِدَ قُبَاءٍ فَصَلَّى فِيهِ صَلاَةً كَانَ لَهُ كَأَجْرِ عُمْرَةٍ যে ব্যক্তি নিজের ঘরে পবিত্রতা অর্জন করলো, অতঃপর কুবা মসজিদে এসে কোন নামাজ পড়লো, তার জন্য একটি উমরার সমান সাওয়াব রয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৪১২)
ও প্রিয় মদিনার মুসাফির ভাই! এ কয়েকটি নিবেদন আপনার কাছে পেশ করলাম এগুলোর উপর যদি সঠিক ভাবে আমল করা যায় তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের সফর সফল এবং সার্থক হবে। প্রিয় নবীজির সাথে আমাদের মুহাব্বতের সম্পর্ক আরো গভীর এবং দৃঢ় হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে প্রিয় নবীজির ভালোবাসায় উজ্জীবিত হওয়া এবং নবীজির সুন্নাহ জিন্দা করার জন্য আমরণ চেষ্টার তৌফিক দান করেন, আমীন।
লেখক: শিক্ষক, লালবাগ মাদ্রাসা ঢাকা, খতিব, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ ঢাকা, পরিচালক, দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ
]]>