'ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামলে উত্তেজনা কাজ করে'

২ সপ্তাহ আগে
ক্রিকেট কিংবা ফুটবল, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারতের লড়াই এখন সবচেয়ে জমজমাট। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই দ্বৈরথ তো আরও জমে উঠেছে। সাফজয়ী ফুটবলার সাহেদা আক্তার রিপাও ভারত-বাংলাদেশের এই দ্বৈরথকেই এগিয়ে রাখলেন সকল লড়াইয়ের চেয়ে। মাত্র দেড় মাস আগে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে আসা এই ফুটবলার আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আরও কথা বলেছেন জাতীয় দলে খেলার অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত জীবন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে।

সময় সংবাদ: সাফের পর থেকেই লম্বা ছুটিতে আছেন। সামনেও তেমন খেলাধুলাও নেই। ছুটির এই সময়টা কিভাবে কাটান?     

 

রিপা: ছুটির সময়টা বাড়িতেই কাটানো হয়। আমার বাসা কক্সবাজারের উখিয়ায়। বেশিরভাগ সময় খেলার মধ্যেই থাকি। তাই ছুটির এই সময়টা পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে ইচ্ছা করে। বাড়িতে এলে পরিবারের সঙ্গে বেশ আনন্দে কাটে। মাঝে মাঝে কাছাকাছি ঘুরতে যাই। আর বাকিটা সময় পরিবারকেই দিই।   

 

সময় সংবাদ: লম্বা ছুটিতে নিজেকে ফিট রাখার জন্য কী করেন? বাড়িতে কি প্রস্তুতির কোনো সুযোগ থাকে?

 

রিপা: বাড়িতে আসলেও মাঝেমধ্যেই খেলি। অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছি আমি ছোটবেলা থেকে ছেলেদের সঙ্গে খেলে অভ্যস্ত। এখনও ছেলেদের সঙ্গেই খেলি। প্রায় প্রতিদিনই অনুশীলন করি। এছাড়া নিজেকে ফিট রাখার জন্যও কিছু ব্যায়াম করি।

 

সময় সংবাদ: বয়সভিত্তিক ফুটবলে অনেক শিরোপা জিতে এসেছেন, অর্জনও অনেক। তবুও আপনার প্রতিক্রিয়ায় মনে হয়েছে, এবারের সিনিয়র সাফ জেতাটা আপনার কাছে বিশেষ অর্জন।

 

রিপা: এটা অবশ্যই আলাদা। বয়সভিত্তিকে আমরা অনেক ট্রফি এনেছি, তবে সেটার চেয়ে এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। এটা সিনিয়র পর্যায়ের টুর্নামেন্ট এবং দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় আসর। আমরা এর আগের বারেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। তাই দেশবাসীর একটা আশা ছিল। সবাই আমাদের খেলা দেখেছে, আমাদের জন্য দু'আ করেছে। ইনশাআল্লাহ আমরা আগামী বছর সাফের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হতে চাই।

 

সময় সংবাদ: অনূর্ধ্ব-১৬ দিয়ে জাতীয় দলে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট খেলা শুরু। এরপর ধীরে ধীরে অনূর্ধ্ব-১৭, ১৯, ২০ খেলে এলেন জাতীয় দলে। নিজের মধ্যে কী পরিবর্তন দেখতে পান এখন?

 

রিপা: যখন প্রথমবার এলাম, তখন আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মেয়ে। অনেক কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু বেগ পেতে হয়েছে৷ সময়ের সাথে সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। আর একটা বিষয় হচ্ছে, সিনিয়র দল আর বয়সভিত্তিক ফুটবল একদমই এক নয়। সিনিয়র দলে খেলতে চাপ নেয়ার ক্ষমতা থাকা লাগে। ২০২২ সালের সাফে যখন জাতীয় দলে সুযোগ পেলাম তখন তো খেলতে পারিনি। এরপর '২৩ সাল থেকে দলের সঙ্গে আছি। নিজের অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আসলে ঠিক বলে বোঝানো যাবে না এটা।

 

সময় সংবাদ: সাফ জিতে এলাকায় অনেক সম্মানিত এবং পুরস্কৃত হয়েছেন। বিভিন্ন সংস্থা থেকেও পেয়েছেন সম্মাননা এবং পুরস্কার। আলাদাভাবে দেখা করে আপনাদেরকে পুরস্কৃত করেছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টা। কী কথা হলো তাদের সঙ্গে?

 

রিপা: যখন চ্যাম্পিয়ন হলাম, তখন থেকেই চেয়েছি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা হোক। আমরা উনার সঙ্গে আমাদের মনের কথা শেয়ার করতে পারব। তাই সবাই অনেক এক্সাইটেড ছিল। দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা উনার কাছে গিয়েছি। উনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমাদের খেলোয়াড় জীবনের এবং ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো শুনেছেন। সমস্যা বাস্তবায়নের আশ্বাসও দিয়েছেন। ক্রীড়া উপদেষ্টার সঙ্গে শুধু ছবি তুলেছি। কথা বলার সু্যোগ হয়নি। 

 

সময় সংবাদ: ৫-৬ বছর ধরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খেলছেন। উখিয়ার মতো একটি অঞ্চল থেকে উঠে এসে দিন দিন নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। আপনার শুরুর দিকের সময়টা কেমন ছিল?

 

 

রিপা: ছোটবেলা থেকেই খেলতাম। বাড়ির সামনেই মাঠ ছিল। এরপর ২০১৭ সালে বিকেএসপির হয়ে ভারতে একটি টুর্নামেন্ট খেলতে যাই। ওই টুর্নামেন্টের পর টাঙ্গাইলে একটা টুর্নামেন্ট খেলি ছোটন (গোলাম রব্বানী) স্যারের দলের হয়ে। সেখান থেকে আসার পর যুব গেমস খেলি। এরপর জেএফএ টুর্নামেন্টে সেরা গোলদাতা এবং মোস্ট ভ্যালুয়েবল খেলোয়াড় হওয়ায় ২০১৮ সালে ডাক পড়ে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে। এখান থেকেই যাত্রা শুরু।

 

সময় সংবাদ: বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকেই তারকা তকমা আপনার নামের পাশে। কিন্তু সিনিয়র দলে আরও বড় বড় তারকা রয়েছে। তাদের নামের ভীড়ে রিপা কিছুটা আড়ালে। বয়সভিত্তিকের রিপাকে নিয়ে যে উন্মাদনা ছিল, সেটাও একটু কমেছে।

 

রিপা: বয়সভিত্তিকের চেয়ে সিনিয়র দল অনেক কঠিন জায়গা। এখানে প্রমাণ করার অনেক কিছু থাকে। অনেক সিনিয়র খেলোয়াড়রা এখানে আছে,  তাই তাদের মধ্যে ভালো করার একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। এখানে শুধু ঢুকলেই হয় না, টিকে থাকার জন্যও লড়াই করতে হয়। এটা একটা বড় শেখার জায়গা। সিনিয়রদের থেকে অনেক কিছু শিখছি আমি। এখানে সবাই নিজের সেরাটা দিয়ে খেলে সেটা একটা বড় শিক্ষণীয় বিষয়।  

 

ইউরোপে-ডানা-মেলতে-চান-সাফের-সেরা-রিপা২০২১ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯-এ সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন রিপা। ছবি: সংগৃহীত 

 

সময় সংবাদ: জাতীয় দলের সিনিয়রদের সাথে সম্পর্ক কেমন?

 

রিপা: সিনিয়র সবার সঙ্গেই সম্পর্ক অনেক ভালো। তবে সাবিনা আপুর সঙ্গে সবচেয়ে ভালো। যেহেতু আমরা কাছাকাছি পজিশনে খেলি। আপুও স্ট্রাইকার, আর আমিও। তাই আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা ভালো। সামনে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে, তাই এখন থেকেই আপু আমাদের প্রস্তুত করে নিচ্ছেন।

 

সময় সংবাদ: জুনিয়র দলে থাকাবস্থায়ও বলতেন, জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা আপনার কাছে স্বপ্নের মতো। সেও স্বপ্নটা অবশ্য খুব দ্রুতই বাস্তবে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। ১৮ বছর বয়সেই জাতীয় দলে ডাক পেলেন। পরের বছরই জিতলেন সাফ। এত অল্প সময়ে সব সাফল্য হাতের মুঠোয় চলে আসাকে কিভাবে দেখছেন?

 

রিপা: সাফল্য তো সবসময়ই ভালো লাগে। তবে চেষ্টা করি নিজেকে প্রতিদিন আরও বেটার করার। আমার অভিষেক হয় নেপালের বিপক্ষে। আগে থেকেই একটা বড় আশা ছিল। সে কারণে উন্মাদনাটাও ছিল অনেক। ভালো করার প্রত্যাশা ছিল। শুরুটা ভালো হয়েছে। সামনে আরও ভালো করার ইচ্ছা আছে।

 

সময় সংবাদ: ২০২২ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ এ সেরা গোলদাতা হয়েছিলেন। সেসময় ওই ট্রফিটা আপনি বন্যাদুর্গতদের জন্য নিলামে তুলেছিলেন। ওই সময় তো আপনার নিজের অর্থনৈতিক অবস্থারই তেমন উন্নতি হয়নি, তবুও এই চিন্তাটা কিভাবে এসেছিল? 

 

রিপা: যেকোনো ট্রফিই আমরা দেশে নিয়ে যেতে চাই। তবে দেশের মানুষ যখন খারাপ থাকে, তখন কোনো ট্রফিই আনন্দ দেয় না। সিলেটে তখন বন্যা চলছিল, অনেক মানুষ কষ্টে ছিল। তাই তাদের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করেছি। অনেক মানুষের দোয়া এবং ভালোবাসা পেয়েছি এটা করে। 

 

ছবি সংগৃহীত২০২২ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ সাফে সেরা গোলদাতা হয়েছিলেন রিপা। ছবি: সংগৃহীত  

  

সময় সংবাদ: নিজ এলাকায় ভালো লাগে নাকি খেলার মধ্যে থাকতেই বেশি ভালো লাগে?

 

রিপা: বাসায় সময় কাটাতে তো ভালোই লাগে। তবে একজন খেলোয়াড় হিসেবে আমার প্রধান কাজ ফিট থাকা এবং মাঠে পারফর্ম করা। বাড়িতে থাকলে রুটিনটা মানা কঠিন হয়। তবে সময়টা বেশ ভালো কাটে।

 

সময় সংবাদ: আপনার নিজের এলাকা উখিয়ায় তো সবাই আপনাকে চেনে। দেশব্যাপীও অনেক পরিচিত। এই পরিচিতির কারণে কোথাও ঘুরতে গিয়ে বা কোনো কাজে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে নাকি?

 

রিপা: এলাকায় সবাই অনেক ভালোবাসে। যেখানেই যাই মানুষের ভালোবাসা পাই। মানুষ ছবি তোলে, দোয়া দেয়। ভালো লাগে। কখনো খারাপ লাগেনি।

 

সময় সংবাদ: এলাকায় উদীয়মান ফুটবলারদের কাছে তো আপনি রোল মডেল। তারা আসে পরামর্শ নিতে?

 

রিপা: হ্যা, প্রায়ই। বাসায় আসে। যেখানেই দেখে আমার থেকে পরামর্শ নেয়। আমিও অনুপ্রেরণা দিই ভালো খেলার।  

 

সময় সংবাদ: দক্ষিণ এশিয়ার পরিসরে তো অনেক দলের সঙ্গেই খেলা হয়েছে। কোন দলের বিপক্ষে খেলাটা সবচেয়ে এনজয় করেন?

 

রিপা: ভারতের বিপক্ষে খেলতে ভালো লাগে। ওরা ভালো দল। ওদের সঙ্গে খেলতে গেলে চাপ থাকে। আমাদের মধ্যেও একটা উত্তেজনা কাজ করে, জিততেই হবে।

 

সময় সংবাদ: কোন ম্যাচটা সবচেয়ে স্মরণীয়?

 

রিপা: নেপালের বিপক্ষে সর্বশেষ সাফ ফাইনাল। ম্যাচে অনেক দর্শক ছিল মাঠে। আমার কাছে দক্ষিণ-এশিয়ার সবচেয়ে কঠিন দলও মনে হয় নেপালকেই।

 

সময় সংবাদ: একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ইউরোপের ক্লাবে খেলতে চান। এটা নিয়ে পরিকল্পনা কী?

 

রিপা: সবার তো ইচ্ছা থাকে নিজেকে আরও ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার। চেষ্টা করছি। সবারই অনেক পরিকল্পনা থাকে। দেখি কী করা যায়।

 

সময় সংবাদ: টিকটক করেন?

 

রিপা: না। অবসর সময়ে বই পড়ি।

 

সময় সংবাদ: সাফের সময় খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কোচ পিটার বাটলার।

 

রিপা: দেখুন খেলার সময় অনেক চাপে থাকে খেলোয়াড়রা। রিফ্রেশমেন্টের জন্য আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়। আমাদের দলের খেলোয়াড়রা নিজেদের চাঙ্গা রাখার জন্য এসব করেন। বাইরের দেশেও এরকম আছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তবে উনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।

 

সময় সংবাদ: কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের হাত ধরেই বেড়ে ওঠা। তার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

 

রিপা: কোচ হিসেবে যদি বলি, আমার জীবনের সেরা কোচ তিনি। প্রথম পরিচয় হয় অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্ট খেলে। এরপর ২০১৮ সাল থেকে তো উনার সঙ্গেই ছিলাম। অনেক স্মৃতি আছে তার সাথে।

 

সময় সংবাদ: এতগুলো ট্রফি জিতলেন দেশের হয়ে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দিক থেকে কোনো আক্ষেপ আছে কি?

 

রিপা: আমার কোনো আক্ষেপ নাই। আমি জীবনে যতটুকু পেয়েছি, তাতেই খুশি।

 

সময় সংবাদ: নিজের এবং দলকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

 

রিপা: এখন পুরোপুরি ফোকাস একদিকেই, সাফে আমরা হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। আর নিজের ইচ্ছা আছে দেশের বাইরে লিগ খেলার। এখন পর্যন্ত কোনো সুযোগ পাইনি। আশা করি সুযোগ হবে সামনে। 

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন