পাখিরা তাদের জন্য উপযুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ পেলে যেখানে সেখানে আবাস গড়ে তোলে। সৈয়দবাড়ি এলাকার শতবর্ষী গাছগুলো পাখিদের জন্য হয়ে উঠেছে নিরাপদ আশ্রয়। প্রতিদিন ভোরবেলা দল বেঁধে তারা হাওরের দিকে উড়ে যায় খাবারের সন্ধানে, আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসে তাদের প্রিয় আশ্রয়ে। এলাকাবাসী বলেন, এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখতে পাওয়া যেন প্রকৃতির এক অনবদ্য উপহার।
চলমান শিকার ও পরিবেশ হুমকির বিপরীতে এই বাড়িটি হয়ে উঠেছে পাখিদের জন্য একটি জীবন্ত অভয়ারণ্য, যেখানে ভালোবাসাই আইন, আর সহানুভূতিই নিরাপত্তা।
এখানে বক, ডাহুক, বালিলেঞ্জা, পানকৌড়ি, শামুক খোল, শালিক, মাছরাঙা, ঘুঘু এবং বাদুরের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীও দেখা যায়। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের মনকেও প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে।
সরকারি বিভিন্ন সূত্র ও স্থানীয়দের মতে, দেশের ৮টি হাওরবেষ্টিত জেলার একটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নদী-নালা, খাল-বিল, মুক্ত জলাশয়ে ভরপুর এই অঞ্চলে পাখির খাবার যেমন শামুক, পোকামাকড়, সাপ, ব্যাঙ, কেচো সহজলভ্য। ফলে এসব অঞ্চলে দেশীয় পাখিদের উপস্থিতি বেড়েছে। তবে উঁচু গাছ ও নিরাপদ আবাসস্থলের অভাবে তারা শহরের সৈয়দবাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। পাখিদের এই নিরাপদ আশ্রয় গড়ে উঠেছে কেবল গাছগাছালির জন্যই নয়, বরং এখানকার মানুষদের ভালোবাসা ও সচেতনতার কারণেও।
সৈয়দবাড়ির প্রবীণ রাজনীতিবিদ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সৈয়দ এমরানুর রেজা বলেন, 'এ পাখি আমাদের বাড়িতে অনেকদিন ধরেই আসে। আমি আমাদের বাড়ির কাউকে বা বাহিরের কাউকে এই পাখি ধরতে দেই না। আমাদের বাড়ির লোকজন যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ কেউ সাহস পায় না। কিন্তু রাতে বেলা কিছু মানুষ পাখিদের শিকার করার চেষ্টা করে। আমি অনেক সচেতন মানুষকে দেখেছি পাখি শিকার করতে।
আরও পড়ুন: মানুষের মতো কথা বলে শালিক পাখি!
বাড়ির গৃহিণী নুজহাত পারভীন বলেন, আমি আমার বিয়ের পর থেকে এখানে এসে পাখিদের আসতে দেখেছি। প্রায় চার দশক হয়েছে আমার বিয়ের। প্রতিবছরই পাখিরা এখানে আসে। পানকুড়ি বকসহ বিভিন্ন পাখি এখানে আছে। আমরাও পাখিদের জন্য এই জায়গাটি সংরক্ষণ রাখি প্রতিবছর। পাখিরা এখানে থাকলে অনেক ছেলেরা পাখিদের ধরার চেষ্টা করে। আমরা সবসময় তাদের বাঁধা দেই। পাখিদের শিকার করলে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। পাখিরা এখানে নিরাপদ বোধ করে বিধায় এখানে আসে। আমরা চাইবো কেউ যেন পাখিদের শিকার না করে।
তিনি আরও জানান, রাতের আঁধারে কিছু শিকারি পাখি ধরার চেষ্টা করলেও তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন তা রোধ করতে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বাড়ির গৃহিণী নুজহাত পারভীন বলেন, আমি আমার বিয়ের পর থেকে এখানে এসে পাখিদের আসতে দেখেছি। প্রায় চার দশক হয়েছে আমার বিয়ের। প্রতিবছরই পাখিরা এখানে আসে। পানকুড়ি বকসহ বিভিন্ন পাখি এখানে আছে। আমরাও পাখিদের জন্য এই জায়গাটি সংরক্ষণ রাখি প্রতিবছর। পাখিরা এখানে থাকলে অনেক ছেলেরা পাখিদের ধরার চেষ্টা করে। আমরা সবসময় তাদের বাঁধা দেই। পাখিদের শিকার করলে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। পাখিরা এখানে নিরাপদ বোধ করে বিধায় এখানে আসে। আমরা চাইবো কেউ যেন পাখিদের শিকার না করে।
সৈয়দবাড়ির বাসিন্দা ও স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, 'এখানে প্রায় ৪-৫ ধরনের বকসহ বিভিন্ন পাখি আসে। পাখিদের কলতানে প্রতিদিন একটি চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয় পাখিদের কাছে এই জায়গাটি অনেকটা নিরাপদ আবাসস্থল। যার কারণে এটি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ বাড়ির লোকজনও পাখিদের জন্য জায়গাটি সংরক্ষণ রেখেছে। এখানে উঁচু গাছ থাকার কারণে পাখিরা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বিভিন্ন ধরনের পাখিদের এখানে আসা-যাওয়াটা সুন্দর একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ জায়গাটির মতো সুন্দর দৃশ্য সহসাই চোখে পড়ে না। কিন্তু এলাকার কিছু মানুষ এসব পাখি শিকারের চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে আমরা প্রশাসনে সহযোগিতা চাই।
জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. হাবিবুল ইসলাম বলেন, 'পাখিরা পরিবেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর এখানে বিভিন্ন পাখির অনেক বিচরণ ঘটে। তারই প্রেক্ষাপটে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাতে প্রচুর বড়-বড় গাছ আছে। এখানে বিল, হাওর, নদী-নালা ও মুক্ত জলাশয় আছে। যার কারণে পাখিরা সুন্দরভাবে অভয়ারণ্যের মতো এখানে বিচরণ করতে পারে। প্রতিবছরের এই সময়ে প্রচুর সংখ্যক পাখির আগমন এখানে হয়ে থাকে। পরিবেশগতভাবে তাদের বিচরণের ক্ষেত্রে আমাদের সবারই পাখিদের আশ্রয়স্থল আমাদের রক্ষা করা উচিত।'
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের প্রকৃতি নির্ভর দেশ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বদরুনেচ্ছা সীমা বলেন, 'পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাখিদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। পাখিরা পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে থাকে যার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকে। পাখির যে অভয়ারণ্য রয়েছে তেমন অভয়ারণ্য আমাদের আরো অনেক প্রয়োজন। সেজন্য আমাদের প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সামাজিক বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বলেন, 'আমাদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন রয়েছে। সেই আইনের আলোকে পাখি শিকার করা এবং বিক্রি করা রোধে আমরা কাজ করছি। কয়েকদিন আগেও বিভিন্ন পাখির বাজারে অভিযান করে আমরা কিছু পাখি অবমুক্ত করেছি। বন্যপ্রাণীরা আমাদের পরিবেশের একটি অংশ। এদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা বিভিন্ন হাওরে জলজ গাছ যেমন হিজল তমাল সহ বিভিন্ন প্রজাতির জলদ গাছ রোপণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এতে করে মাছেদের যেমন খাবার হবে অন্যদিকে পাখিদেরও একটি আবাস স্থল হবে। আমাদের সে পরিকল্পনা রয়েছে।'
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবসহ বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর মধ্যে ২০৮ প্রজাতির শীতকালীন পরিযায়ী, ১২ প্রজাতির গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী, ১৪ প্রজাতির পান্থ পরিযায়ী এবং ১১৯ প্রজাতির ভবঘুরে পাখি রয়েছে।
পাখিদের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সচেতনতা এবং প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ— এই তিনটির সম্মিলনেই গড়ে উঠতে পারে নিরাপদ পাখির অভয়ারণ্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সৈয়দবাড়ি সেই বাস্তব উদাহরণ। এখন প্রয়োজন শুধু আইনানুগ স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।