বিয়ে পড়ানোর ইসলামি নিয়ম

৫ দিন আগে
বিয়ের আরবি শব্দ নিকাহ। শাব্দিক অর্থ দু’টি জিনিস একত্রিত করা। কখনও কখনও নিকাহ বন্ধন বা চুক্তি অর্থে ব্যবহৃত হয়। শরিয়তের পরিভাষায় বিয়ে হলো, এমন একটি চুক্তি যাতে বিবাহ দেয়া বা বিবাহ করা ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে উপভোগ বা একত্রে থাকা বা পরস্পর অংশীদার হওয়া বুঝায়।

বিয়ের হুকুম

 

যাদের যৌন চাহিদা রয়েছে তবে জিনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা নেই তাদের জন্য বিয়ে করা সুন্নাত। আর যাদের জিনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের জন্য বিয়ে করা ওয়াজিব। যাদের যৌন চাহিদা নেই যেমন, পুরুষত্বহীন ও বয়স্ক ইত্যাদি লোকের বিয়ে করা বৈধ। তবে প্রয়োজন না থাকলে যারা দারুল হরবে তথা যুদ্ধরত কাফির রাষ্ট্রে অবস্থান করেন তাদের জন্য বিয়ে করা হারাম।

 

বিবাহ সংঘটিত হওয়ার শব্দাবলী

 

যে কোনো ভাষায় বিবাহ করা বা দেয়া বুঝায় এমন সব শব্দে বিবাহ সংঘটিত হবে। যেমন বলা, (زوجت أو نكحت) আমি বিবাহ করলাম বা বিয়ে দিলাম। অথবা বলা, (قبلت هذا النكاح) আমি এ বিয়ে কবুল করলাম। অথবা (تزوجتها) আমি তাকে বিয়ে করলাম, বা (تزوجت) আমি বিয়ে করলাম, অথবা (رضيت) এ বিয়ে আমি রাজি আছি।

 

আরবি ভাষার শব্দ ব্যবহার করা মুস্তাহাব। তবে যারা আরবি ভাষা জানেন না তারা তাদের ভাষায় প্রস্তাবনা ও কবুল করলেই বিয়ে সংঘটিত হবে।


বিবাহের রুকন

 

বিয়ের রুকন দু’টি। ১. প্রস্তাব (الإيجاب): অলি তথা অভিভাবক অথবা যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন তার পক্ষ থেকে বিয়ে করার বা বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া। যিনি আরবি ভালো পারেন তার (إنكاح أو تزويج) শব্দ দ্বারা প্রস্তাব দেওয়া উত্তম। কেননা এ শব্দদ্বয় কোরআনে এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,فَٱنكِحُواْ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ ٱلنِّسَآءِ তোমরা বিয়ে কর নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে। (সুরা আন-নিসা ৩)

 

আরও পড়ুন: স্বপ্নে নিজের বিয়ে দেখলে কী হয়

 

২. কবুল (القبول): স্বামী বা তার স্থলাভিষিক্ত থেকে বিয়ে কবুল করার শব্দ। যেমন বলা, (قبلت) আমি বিয়ে কবুল করলাম বা (رضيت هذا النكاح) এ বিয়ে আমি রাজি আছি বা শুধু কবুল করেছি বলা। ইজাব তথা প্রস্তাব কবুলের আগে হতে হবে, তবে কোনো আলামত থাকলে আগে কবুল বললেও হবে।

 

বিবাহের শর্তাবলী

 

বিয়ের শর্ত চারটি। ১. স্বামী-স্ত্রী নির্ধারিত হওয়া। ২. স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতি থাকা। অতএব, স্বামী-স্ত্রী কাউকে জোর করে বিয়ে দেয়া জায়েজ নেই। কুমারী ও অকুমারী উভয়ের অনুমতি নিবে। কুমারীর চুপ থাকা তার অনুমতি দেওয়া আর অকুমারীর মৌখিক সম্মতি নিতে হবে। পাগল ও নির্বোধের ক্ষেত্রে এটি শর্ত নয়।

 

৩. অভিভাবক: অভিভাবক পুরুষ, স্বাধীন, বালিগ (প্রাপ্তবয়স্ক), আকেল (জ্ঞানবান), বিচক্ষণ ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া শর্ত। এছাড়া একই দীনের অনুসারী হওয়াও শর্ত। বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বাবা তার অভিভাবক হওয়ার সর্বাধিক যোগ্য, অতঃপর বাবার অসিয়তকৃত ব্যক্তি, তার দাদা, এভাবে উর্ধতন দাদারা, তার ছেলে ও নিম্নতম ছেলেরা, তার সহোদর ভাই, অতঃপর তার বৈমাত্রেয় ভাই, অতঃপর এসব ভাইয়ের ছেলেরা, অতঃপর, আপন চাচা, অতঃপর বৈমাত্রেয় চাচা, অতঃপর তাদের সন্তানেরা, অতঃপর বংশীয় নিকটাত্মীয়রা, অতঃপর দেশের বাদশাহ অভিভাবক হবেন।

 

৪. সাক্ষ্য: ন্যায়পরায়ণ, পুরুষ ও শরিয়তের বিধান প্রযোজ্য (প্রাপ্তবয়স্ক) এমন দুজন সাক্ষ্যের সাক্ষী ছাড়া বিয়ে শুদ্ধ হবে না। ৫. স্বামী-স্ত্রী উভয়ে বিবাহ বন্ধনে শরিয়তের নিষেধাজ্ঞামুক্ত থাকা (অর্থাৎ যাদের সাথে বিয়ে হারাম তাদের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া)।


বিবাহ পড়ানোর সুন্নাহ পদ্ধতি

 

প্রথমে কনের কাছ থেকে ইজন বা অনুমতি নিতে হবে। বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী বা বর-কনেই মুখ্য, যারা সারা জীবন একসঙ্গে ঘর-সংসার করবে। তাই বিবাহের আগে তাদের সম্মতি থাকতে হবে।

 

আরো পড়ুন: নামাজের সামনে দিয়ে গেলে যে মারাত্মক গুনাহ হয়

 

কোনো অবস্থায়ই কোনো ছেলে-মেয়ের অসম্মতিতে তাদের বিবাহ করতে বাধ্য করা উচিত নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে তোমরা বলপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হবে। (সুরা নিসা ১৯) 

 

হযরত আবু সালামা রা. থেকে বর্ণিত, আবু হুরায়রা রা. তাদের কাছে বর্ণনা করেন যে নবী সা. বলেছেন, কোনো বিধবা নারীকে তার সম্মতি ছাড়া বিয়ে দেয়া যাবে না এবং কুমারি নারীকে তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! কিভাবে তার অনুমতি নেওয়া হবে। তিনি বলেন, তার চুপ থাকাই তার অনুমতি। (বুখারি ৫১৩৬)

 

অতঃপর অভিভাবক (যদি বিবাহ পড়াতে সক্ষম হন) বা যিনি বিবাহ পড়াবেন তিনি বিবাহের খুতবা পাঠ করবেন। এরপর মেয়ের অভিভাবক বরের সামনে মেয়ের পরিচয় ও মোহরের পরিমাণ উল্লেখ করবেন। তারপর তিনি বিবাহের প্রস্তাব পেশ করবেন। অথবা অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে যিনি বিবাহ পড়াবেন তিনি হবু বরের কাছে বিবাহের প্রস্তাব তুলে ধরবেন। এটাকে ইসলামের ভাষায় ‘ইজাব’ বলা হয়।

 

বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। বিশেষ করে মেয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি একান্তভাবে আবশ্যক। কারণ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ হয় না। নবী করিম সা. বলেন, অভিভাবক ছাড়া কোনো বিবাহ নেই। (তিরমিজি ১১০১)

 

যিনি বিয়ে পড়াবেন তিনি উপস্থিত মজলিসে হবু বরের উদ্দেশে বলবেন যে অমুকের মেয়ে অমুককে এত টাকা মোহরানায় আপনার কাছে বিবাহ দিলাম, আপনি বলুন ‘কবুল’ বা ‘আমি গ্রহণ করলাম’।

 

বিয়ে পড়ানোর সময় কমপক্ষে দুজন সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হবে। তখন বর উচ্চ স্বরে  ‘কবুল’ অথবা ‘আমি গ্রহণ করলাম’ বা সম্মতিসূচক ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলবে। এরূপ তিনবার বলা উত্তম। (বুখারি ৯৫) স্মরণ রাখতে হবে যে আগে খুতবা পাঠ করতে হবে তারপর ইজাব-কবুল (প্রস্তাব দেওয়া-নেয়া)।

 

শুধু বরকেই কবুল বলাতে হবে। কনের কাছ থেকে কনের অভিভাবক শুধু অনুমতি নেবেন। বর বোবা হলে সাক্ষীদ্বয়ের উপস্থিতিতে ইশারা বা লেখার মাধ্যমেও বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে। এভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে। এরপর উপস্থিত সবাই পৃথকভাবে সুন্নতি দোয়া পাঠ করবে, ‘বা-রাকাল্লাহু লাকা, ওয়া বা-রাকা আলাইকা, ওয়া জামাআ বায়নাকুমা ফী খায়ের।’

 

‘আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত দিন ও তোমাদের দুজনকে কল্যাণের সঙ্গে মিলিত করুন।’ (তিরমিজি ১০৯১)

 

বিবাহের খুতবা: বিবাহের খুতবার জন্য প্রথমে নির্দিষ্ট কাঠামোতে হামদ ও সানা বা আল্লাহর প্রশংসা করবে। অতঃপর পবিত্র কোরআনের তিনটি আয়াত পাঠ করবে, যা যথাক্রমে সুরা নিসা, আয়াত: ১, সুরা আলে ইমরান ১০২ এবং সুরা আহজাব, আয়াত : ৭০-৭১। (সুনানে আবু দাউদ ২১১৮)

 

আরও পড়ুন: দোয়া কবুল হওয়ার তিন আমল

 

বিয়ে শরিয়তসম্মত হওয়ার হিকমত

 

বিবাহ ইসলামের একটি অন্যতম সুন্নাত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাহ করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, «يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ»

 

হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করার সামর্থ রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে। আর যাদের বিবাহ করার সামর্থ্য নেই, সে যেন সাওম পালন করে, কেননা, সাওম তার যৌনতাকে দমন করবে।

 

এছাড়াও পারিবারিক সম্পর্ক বজায়, পরস্পর ভালোবাসা বিনিময়, আত্মসংযম ও হারাম কাজ থেকে নিজেকে হিফাজত করতে বিবাহ একটি উত্তম মাধ্যম ও উপায়।

 

(হালালভাবে) বংশ পরিক্রমা ঠিক রেখে সন্তান জন্ম দেওয়া ও বংশ বিস্তারে বিবাহ একটি উত্তম পদ্ধতি। নানা রোগ-ব্যাধিমুক্ত ও নিরাপদে মানুষের যৌন চাহিদা মিটাতে ও মনোবাসনা পূরণ করতে বিবাহ একটি সুন্দরতম পদ্ধতি। বিয়ের মাধ্যমে সন্তান লাভের দ্বারা পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের স্বাদ ভোগ করা যায়। বিবাহে রয়েছে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য শান্তির আবাস, প্রশান্তি, শালীনতা ও সচ্চরিত্র।

 

বিয়েতে যেসব কাজ সুন্নাত ও যেসব কাজ হারাম

 

যে ব্যক্তি দীনদারিতা, ভিনদেশীয়তা, কুমারী, সন্তান ও সৌন্দর্য্যের ব্যাপারে ন্যায়পরায়ণতা ও সমতা বজায় রাখতে পারবে না তার জন্য একটি বিয়ে করা সুন্নাত। বিয়ের খিতবা তথা প্রস্তাব দেওয়া কন্যাকে সতর ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভালোভাবে দেখা মুস্তাহাব, যাতে তাকে বিয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলে, তবে নির্জনে দেখতে পারবে না। এমনিভাবে কনেও হবু বরকে ভালোভাবে দেখা মুস্তাহাব।

 

বিয়ের প্রস্তাবকারী বরের পক্ষে মেয়েকে দেখা সম্ভব না হলে সে একজন বিশ্বস্ত নারী পাঠাবে, তিনি ভালোভাবে দেখে তাকে মেয়ের গুণাবলী বর্ণনা করবে। কেউ কোনো মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলে উক্ত প্রস্তাবকারী তার প্রস্তাব ফিরিয়ে নেওয়া বা তাকে দেখার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত অন্য কেউ উক্ত মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হারাম।

 

যেসব নারী তিন ত্বালাক ব্যতীত বায়েন ত্বালাকের ইদ্দত পালনরত তাদেরকে স্পষ্ট বা ইশারায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া বৈধ। তবে রাজ‘ঈ তালাকের ইদ্দত পালনকারী নারীকে স্পষ্ট বা ইশারায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হারাম।

 

আরও পড়ুন: রক্ত দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা কি জায়েজ?

 

জুমার দিন (শুক্রবার) বিকেলে বিয়ে পড়ানো সুন্নাত। কেননা আসরের সালাতের পরের সময় দো‘আ কবুল হয় এবং সম্ভব হলে মসজিদে বিয়ে পড়ানো সুন্নাত। (বুখারি ৪৭৭৮, মুসলিম ১৪০০, তিরমিজি ১০৮১, নাসাঈ ২২৪০, আবু দাউদ ২০৪৬)

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন