বাবার নির্দেশে স্ত্রীকে তালাক দেয়া যায়?

১ সপ্তাহে আগে
তালাক মানে ত্যাগ করা। শরিয়তে ইসলামিয়ায় আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদকে তালাক বলা হয়। ইসলামে তালাক দেয়া বৈধ হলেও অনুৎসাহিত করা হয়েছে। যৌক্তিক কারণে তালাক দেয়া হলে এর কিছু নিয়মকানুন আছে। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দের বৈধ বিষয় তালাক।

বাবা-মায়ের আদেশ পালন করা ওয়াজিব। সুতরাং বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই অসদাচারণ করা যাবে না। মনে রাখবেন, পিতামাতার সেবা ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাদের মুসলমানও হওয়া জরুরি নয়। মহান আল্লাহ বলেন- وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا

 

পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। (সুরা লুকমান ১৫)

 

কিন্তু তারা যদি অন্যায় আদেশ করে, তাহলে তা পালন করা হারাম। কেননা, ইসলামের শিক্ষা হল,

 

لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা যেখানে আসবে, সেখানে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। সৃষ্টির আনুগত্যের সীমারেখা বর্ণনা করতে গিয়ে রসুল সা. বলেন, فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ অসৎকাজে আনুগত্য নয় ;আনুগত্য কেবল সৎকাজের ক্ষেত্রেই হতে হবে। (বুখারি৭১৪৫)

 

আরো পড়ুন: নামাজের সামনে দিয়ে গেলে যে মারাত্মক গুনাহ হয়

 

সুতরাং বাবা-মা বউকে তালাক দিতে বললে কারণ জানতে হবে। কারণ যদি সঠিক ও যুক্তিসংগত হয়, সে কারণে তালাক ছাড়া আর কোনো পথ বাকি না থাকে, পাশাপাশি যদি তালাক প্রদান করার মাধ্যমে আপনার জিনায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে পিতা মাতার সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে।

 

عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: كَانَتْ لِي امْرَأَةٌ كُنْتُ أُحِبُّهَا، وَكَانَ أَبِي يَكْرَهُهَا، فَقَالَ لِي: طَلِّقْهَا، فَأَبَيْتُ، فَأَتَى رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ، فَقَالَ: «طَلِّقْهَا» فَطَلَّقْتُهَا

 

হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার একজন স্ত্রী ছিল। যাকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা (হযরত উমর বিন খাত্তাব রা. যৌক্তিক কারণে) তাকে পছন্দ করতো না। 

 

তিনি আমাকে বললেন, তাকে তালাক দিতে। কিন্তু আমি তালাক প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানালাম। তখন আমার পিতা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে তালাক দিয়ে দিতে। ফলে আমি আমার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করি। (মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসি ১৯৩১, মুসনাদে আহমাদ ৪৭১২, সুনানে আবু দাউদ ৫১৩৮) পক্ষান্তরে কারণ যদি সঠিক না হয়, কেবল বউয়ের প্রতি ঈর্ষাবশত হয়, তাহলে তালাক দেয়া আপনার জন্য জায়েজ নয়।

 

আসলে পুরুষকে সংসারের এই মা-বউয়ের দ্বন্দ্বে পরীক্ষা দিতে হয়। এক্ষেত্রে শরিয়তই হচ্ছে সঠিক ফয়সালাদাতা। সুতরাং  সতর্ক থাকতে হবে যে, কোন আবেগ বা প্রেম, কোন ঈর্ষা বা হিংসা অথবা কোন পার্থিব লোভ লালসা যেন কারো প্রতি অন্যায়াচরণে বাধ্য না করে। 

 

এজন্য ধৈর্য ধারণ করুন, কম বলুন, বেশি শুনুন। বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন পিতামাতার মন-মানসিকতার পরিবর্তন হয়। স্ত্রীকে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার উপদেশ দিন। আপনার মা-বাবাকে বোঝান যে, তারা যেন বউয়ের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেন। তার সাথে স্নেহ-মমতার আচরণ করেন। নিজের মেয়েকে যেভাবে ভুল হলে ক্ষমা করেন, সে চোখে যেনো স্ত্রীকে দেখে। আর স্ত্রীকে বলবেন, যেনো নিজের বাবা মায়ের মতো মনে করে। তাহলেই পারিবারিক দ্বন্দ্ব হবে না। সুখ শান্তি আর আল্লাহর রহমত পরিবারে থাকবে।


তিন তালাক ছাড়া কি তালাক হয় না?

 

অনেকে মনে করে যে, শুধু এক বা দুই তালাক দেয়ার মাধ্যমে তো তালাকই হয় না। তালাকের জন্য একসাথে তিন তালাক দেওয়াকে তারা অপরিহার্য মনে করে। মনে রাখবেন, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি হল, শুধু এক তালাক দেওয়া। 

 

আরও পড়ুন: দোয়া কবুল হওয়ার তিন আমল

 

পরবর্তীতে আবারও প্রয়োজন হলে শুধু এক তালাকই দিবে। এরচেয়ে বেশি দিবে না। কিন্তু তিন তালাক দিয়ে ফেললে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখার সকল পথ বন্ধ হয়ে যাবে। একই মজলিসে কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া হারাম ও কবিরা গুনাহ। কিন্তু কেউ এমনটি করলে তালাক কার্যকর হবে এবং তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে।

 

তালাকের সাথে কি বায়েন শব্দ ব্যবহার করা জরুরি?

 

অনেকে মনে করে, শুধু তালাক বললে তালাক হয় না; বরং তালাকের সাথে ‘বায়েন’ শব্দও যোগ করা অত্যাবশ্যক। এটিও ভুল ধারণা। শুধু তালাক শব্দ দ্বারাই তালাক হয়ে যায়। এর সাথে ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। উপরন্তু এ শব্দের সংযোজন নাজায়েয। তবে কেউ যদি এক তালাক বায়েন বা দুই তালাক বায়েন দেয় তবে সে মৌখিকভাবে রুজু করার (পুনরায় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার) পথ বন্ধ করে দিল। এখন শুধু একটি পথই খোলা আছে।

 

আর তা হল, নতুনভাবে শরিয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো। অথচ শুধু তালাক বললে এক তালাক বা দুই তালাক পর্যন্ত মৌখিক রুজুর পথ খোলা থাকে। এজন্য স্বামীর উচিত, যত উত্তেজিতই হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই যেন তিন তালাক না দেয়। 

 

এমনকি তা কখনো মুখেও না আনে। অথচ অনেকে তো তিন তালাক দেওয়ার পরও পৃথকভাবে ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করেন। যেন সব কটি তালাক দেওয়ার পরও তার মন ভরল না। না হলে তিন তালাক দেওয়ার পর আর কী বাকি থাকে যে, ‘বায়েন’ শব্দ বলতে হবে? তিন তালাক দেওয়াই এক গুনাহ, এরপর ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করে সে আরো বেশি গুনাহগার হল।

 

একসাথে তিন তালাক দিলে কি তালাক হয়?

 

অনেকে এই ভুল ধারণাও প্রচার করে রেখেছে যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া হলে তালাক হয় না কিংবা শুধু এক তালাক হয়। এটিও একটি মারাত্মক ভুল। একসাথে তিন তালাক দেওয়া জায়েয না হলেও কেউ যদি এই নাজায়েয কাজ করে তাহলে তার স্ত্রীর উপর তিন তালাক ঠিকই পতিত হয়। এক্ষেত্রে তার মৌখিকভাবে রুজু করার অধিকার অবশিষ্ট থাকে না।

 

এমনকি নতুন করে বিবাহ দোহরিয়ে নেওয়ার দ্বারাও তারা একে অপরের জন্য হালাল হতে পারে না। তাই সকল স্বামীরই কর্তব্য, প্রথম থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। মুখ দিয়ে কখনো তিন তালাক কিংবা তালাক, তালাক, তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর আগেই দুই তালাক দিয়ে থাকলে এখন আর তৃতীয় তালাকের চিন্তাও না করা।

 

গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক পতিত হয়?

 

অনেকে এই মাসআলা বানিয়ে রেখেছে যে, গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে তা কার্যকর হয় না। এটিও সম্পূর্ণ অবাস্তব কথা। গর্ভাবস্থায় হোক বা অন্য যেকোনো অবস্থাই হোক তালাক দেওয়া হলে তা পতিত হয়ে যায়। এজন্য সঠিক মাসআলা শেখা সকলের দায়িত্ব। অজ্ঞতার ধোঁকায় থাকার কারণে হারাম কখনো হালাল হতে পারে না।

 

তালাক পতিত হওয়ার জন্য কি সাক্ষী জরুরি?

 

অনেকের ধারণা, স্বামী তালাকের সময় কোনো সাক্ষী না রাখলে তালাক পতিত হয় না। আগেরটার মতো এটাও মানুষের মনগড়া মাসআলা। কোন মূর্খ এই কথা বলেছে জানা নেই। সাক্ষীর প্রয়োজন তো হয় বিবাহের সময়। তালাক পতিত হওয়ার জন্য এক বা একাধিক কোনো সাক্ষীরই প্রয়োজন নেই। স্বামী যদি রাতের অন্ধকারে একা একা বসে তালাক দেয় তাহলেও তালাক হয়ে যায়।

 

রাগের অবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক হয় না?

 

তালাক তো দেয়াই হয় রাগ হয়ে। কয়জন আছে, শান্তভাবে তালাক দেয়? আসলে তো এমনই হওয়া উচিত ছিল যে, যদি বাস্তবসম্মত ও অনিবার্য প্রয়োজনে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় তাহলে বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করে একে অন্যের কল্যাণকামী হয়ে বুঝে-শুনে, সঠিক মাসআলা জেনে নিয়ে মাসআলা অনুযায়ী তালাক প্রদানের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে।

 

কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মানুষ মাসআলা জানার চেষ্টাও করে না, আর না তাদের মধ্যে এই সুবুদ্ধি আছে যে, বড়দের সাথে পরামর্শ করবে, চিন্তা-ভাবনা করবে। নিজের ইচ্ছাবিরোধী কোনো কিছু পেলেই রাগের বশে তালাক দিয়ে ফেলে। আর তা এক বা দুইটি নয়; এক নিঃশ্বাসে তিন তালাক।

 

আরও পড়ুন: রক্ত দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করা কি জায়েজ?

 

যখন রাগ প্রশমিত হয় তখন অনুতপ্ত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের কথা বানাতে থাকে। বলে, আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি, তালাক দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এসব লোকের জেনে রাখা উচিত যে, তালাক পতিত হওয়ার জন্য নিয়তের কোনো প্রয়োজন নেই।

 

এটা কোনো ইবাদত নয় যে, এর জন্য নিয়ত করতে হবে। নিয়ত থাক বা না থাক সর্বাবস্থায় তালাক শব্দ বলে ফেললে বা কাগজে লিখে দিলেই তালাক হয়ে যায়। তেমনিভাবে রাগের অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়, এমনকি হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন