২০১৯ সাল থেকে সরকারের বিশেষ বিবেচনায় প্রতিবছর দুর্গাপূজায় ইলিশ রফতানি হচ্ছে। চলতি বছর ভারতে ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ মাছ রপ্তানির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের ৩৭ জন রফতানিকারককে ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেয়া হয়।
এবার মন্ত্রণালয় প্রতি কেজি ইলিশের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করেছে ১২ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো (সোমবারের ডলারের মূল্য ১২১.১৫ ধরে)। রপ্তানির জন্য নির্ধারিত সাইজ ৯০০ গ্রামের (এলসি সাইজ) ইলিশ। অর্থাৎ প্রতি মণের রফতানি মূল্য ৬০ হাজার টাকা।
অথচ বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে সোমবার এলসি সাইজের ইলিশ বিক্রি হয়েছে মণ (৪২ কেজি) প্রতি ৭৫ হাজার টাকা। কেজি পড়ছে ১ হাজার ৮০০ টাকার কাছাকাছি। অর্থাৎ স্থানীয় বাজারের চেয়ে কাগজে কলমে মণ প্রতি ১০ হাজার টাকা কমে (কেজিতে ২৫০ টাকা কম) ইলিশ ভারতে পাঠাচ্ছেন রফতানিকারকরা।
পাথরঘাটার কয়েকজন মৎস্য ব্যবসায়ী সময় সংবাদকে জানিয়েছেন, রফতানিকারকরা আড়ৎ থেকে আগের মতোই বাজারমূল্যেই মাছ নিয়ে যাচ্ছেন।
এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি, এখানে যে দামে বিক্রি হচ্ছে তারচেয়ে কম দামে ভারতে রফতানি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখন থেকে বাজারদরেই মাছ কিনছেন রফতানিকারকরা। এরপর কীভাবে কম দামে পাঠাচ্ছেন তা আমরা বুঝতে পারছি না।
কলকাতার বাজারে দাম ঠিকই বেশি
বাংলাদেশ থেকে কাগজে কলমে কম দামে আমদানি হলেও কলকাতার বাজারে ঠিকই বেশি দামে তা বিক্রি হচ্ছে ইলিশ মাছ।
কলকাতার ইলিশ বিক্রেতা ক্ষিতীশ দাস সময় সংবাদকে জানিয়েছেন, রোববার সেখানে খুচরা পর্যায়ে ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি সাইজের বাংলাদেশি ইলিশ ২ হাজার রুপির আশপাশে বিক্রি হয়েছে, বাংলাদেশি টাকায় যা ২ হাজার ৭০০’র মতো (সোমবারের মূল্য অনুযায়ী রুপির দর ১.৩৭ টাকা ধরে)।
রোববার ঢাকার বিভিন্ন বাজারে এই সাইজের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। সে হিসেবে খুচরা পর্যায়ে কলকাতার দাম প্রায় ৫০০ টাকা বেশি।
হুন্ডির খেলা
বরিশাল মৎস্য আড়ৎদার সমিতির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় সময় সংবাদের। তাদের একজন উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন-
বাংলাদেশের বাজারে বর্তমানে ইলিশের কেজি চলছে ২ হাজার ২০০ টাকার মতো। তাহলে রফতানির জন্য নির্ধারিত দামের চেয়ে কম হচ্ছে ৭০০ টাকার মতো। ভারতের বাজারে যদি ২ হাজার রুপিতে বিক্রি হয় তাহলে তো বাংলাদেশি টাকায় ২ হাজার ৫০০ দাঁড়াচ্ছে। আমি এখানে যদি ২ হাজার টাকায় কিনি আর কলকাতায় ২ হাজার ৫০০ টাকা বিক্রি করি তাহলে তো আমার কেজিতে ৫০০ টাকা লাভ হয়, এলসিতে যে দামই দেখাই না কেন। আমার জন্য তো কোনো সমস্যা নাই।
কিন্তু ভারতের বাজরে বেশি দামে বিক্রি হলে বাংলাদেশি রফতানিকারকদের লাভ কী? কারণ, ভারতে এলসি খুলে যারা আমদানি করছে তারাই তো সেখানকার বাজারে বিক্রি করছেন।
জবাবে একজন রফতানিকারক জানানেল, বাংলাদেশ থেকে যারা ইলিশ রফতানি করছেন তাদেরই কেউ কেউ আবার ভারত থেকে আমদানিও করছেন। অর্থাৎ, ভারতে নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এলসি খুলে সরকার নির্ধারিত মূল্যে আমদানি করছেন। সহজভাবে বললে- বাংলাদেশের আড়ৎ থেকে মাছ যিনি কিনছেন তিনিই রফতানি করছেন এবং ভারত থেকে তিনিই আবার সেই মাছ নিচ্ছেন।
কিছু কিছু রফতানিকারকের আত্মীয়-স্বজন ভারতে থাকেন। তাদের কাছে বাংলাদেশ থেকে সরকার নির্ধারিত কম মূল্য দেখিয়ে ইলিশ পাঠানো হচ্ছে। তারা আবার কলকাতায় বাজার মূল্যে সেগুলো বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশের ইলিশ ভারত হয়ে অন্য দেশেও যাচ্ছে
বাংলাদেশ থেকে পাঠানো ইলিশ ভারত হয়ে অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছেন অনেক রফতানিকারক।
বরিশালের এক রফতানিকারক বলেন, সিঙ্গাপুরে এক কেজি ইলিশের দাম পড়ে যায় ৪ হাজার টাকার মতো। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তো সরাসরি অন্য দেশে রফতানির অনুমতি নেই। কিন্তু ভারত হয়ে পাঠালে তো লাভ।
চোরাই পথেও ইলিশ যায় ভারতে
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ রফতানি করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিবারই রফতানির সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। বরিশালের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, নির্ধারিত সময়ের পরেও পশ্চিমবঙ্গে যখন বিভিন্ন পূজা-পার্বণ এবং উৎসব হয় তখন বাংলাদেশ থেকে কালোবাজারিতে ইলিশ যায়।
তারা জানান, এই ইলিশগুলো থাকে বড় সাইজের। ভারতে বড় ইলিশ তেমন ধরা পড়ে না। কিন্তু কলকাতার বাজারে বড় ইলিশের চাহিদা থাকে। অনেক সময় তেলাপিয়াসহ অন্য মাছের ভেতরে লুকিয়েও ইলিশ পাচার হয়।
আরও পড়ুন:
সাগরে ইলিশ কমে যাওয়ার কারণ কী?
রহস্যময় পুরুষ ইলিশ! কেন তেমন দেখা মেলে না?
পদ্মার সেই সুস্বাদু ইলিশ হারিয়ে গেল কোথায়?
রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ
ব্যবসায়ীরা জানান, এলসির মাধ্যমে যে অর্থ পরিশোধ করা হয় সেটা বৈধ পথে ডলারের মাধ্যমে আসে। আর ভারতে বিক্রি করে লাভের যে অতিরিক্ত টাকা সেটা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আনা হয়। ফলে ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও দেশের ক্ষতি হচ্ছে।
এবার অনুমোদিত ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি হলে বাড়তি মূল্য (প্রতি কেজিতে ২৬০ টাকা) হিসাব ধরলে প্রায় ৩০ কোটি টাকা হুন্ডি মাধ্যমে লেনদেনের আশঙ্কা আছে। আর ভারতের বাজার দর অনুযায়ী হিসাব করলে অবৈধ পন্থায় অর্থ আদান-প্রদানের পরিমাণ আরও অনেক বাড়তে পারে বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী।
বেনাপোলের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সম্রাট জানান, কম মূল্যে দেখিয়ে ইলিশ রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ কমবে। এতে অবৈধ লেনদেনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
বেনাপোল স্থলবন্দর মৎস্য ও মান-নিয়ন্ত্রণ অফিসের ইন্সপেক্টর আসাওয়াদুল ইসলাম জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি কেজি ইলিশ ১২.৫ ডলার মূল্যে রফতানির সুযোগ দিয়েছে। এই কারণে বাজার মূল্যের কমে রফতানি হলেও তাদের আটকানোর সুযোগ নেই।
এসময় তিনি আরো জানান, গত ৯ দিনে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১০ জন রফতানিকারক ভারতে ১০২ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানি করেছেন।
**এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সময় সংবাদের কলকাতা ব্যুরো প্রধান সুব্রত আচার্য, বরিশাল ব্যুরো প্রধান অপূর্ব অপু, বেনাপোল প্রতিনিধি আজিজুল হক এবং বরগুনা প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম মিরাজ।
]]>