শনিবার (৩০ আগস্ট) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের গ্রান্ড বলরুমে এ কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের স্বাস্থ্যখাতের নীতিনির্ধারক, গবেষক, বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ও চিকিৎসাযন্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন সহযোগীরা অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রধান অতিথি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশ নেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের পূর্ণ আস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। উন্নত চিকিৎসার আশায় প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে গিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন। অথচ পরিস্থিতি উল্টো হওয়ার কথা ছিল- চিকিৎসার জন্য মানুষকে বাংলাদেশে আসতে আকৃষ্ট করার মতো সক্ষমতা আমাদের গড়ে তোলা উচিত ছিল।
স্বাস্থ্যখাতের নানা সংকট তুলে ধরে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দেশে বড় বড় অবকাঠামো নির্মিত হলেও সেখানে পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তার থাকলেও নার্স নেই। দক্ষ জনবলের এই সংকটে সাধারণ মানুষ মানসম্মত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই স্বাস্থ্যখাতের বিনিয়োগকারীদের উচিত সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করে স্বল্পমূল্যের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে তোলা।
আরও পড়ুন: ‘বসন্তের শহরে’ চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা, অভিজ্ঞতা কেমন?
এ সময় মানসম্মত স্বাস্থ্য খাতের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে সমন্বয় জরুরি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ-সেনাবাহিনীর মতো স্বাস্থ্যখাতেরও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তবে আমাদের দেশে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ অত্যাচারে পরিণত হয়। তাই স্বাস্থ্য খাতকে নিরাপদ রাখার জন্য অবশ্যই একটি মাত্রা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে, কিন্তু এটি যেন অত্যাচারে রূপ না নেয় এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ দুর্নীতিগ্রস্থ না হয়। নিয়ন্ত্রণ যেন সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।’
সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালনবিধি প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ‘অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো নির্দিষ্ট আইন ছিল না। এবার থেকে সব সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার একটি সাধারণ আইন মেনে চলবে।’
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট অযথা অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা গড়ে উঠেছে। এসব সংস্থার যাতাকলে পড়ে খাতটি এগোতে পারছে না। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে এ খাতকে আরও উন্মুক্ত করা। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে স্বনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিতে হবে। কারণ পৃথিবীর কোথাও সরকার সব কিছুই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না- এটা কেবল বাংলাদেশেই দেখা যায়। যেখানে যত বেশি নিয়ন্ত্রণ, সেখানে দুর্নীতিও তত বেশি। প্রকৃতপক্ষে এসব নিয়ন্ত্রণই মূলত দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে।’ বিএনপি ক্ষমতায় আসলে জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: বাড়তি টাকা আর আবর্জনার ফাঁদে নিটোরের রোগীরা
বেসরকারি চিকিৎসা খাতকে ব্যবসামুখীর পরিবর্তে সেবামুখী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি চিকিৎসা খাতকে সেবামুখী হতে হবে, কেবল ব্যবসামুখী নয়। এজন্য মানসম্মত ও যথাযথ সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। একইসঙ্গে চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে উদ্যোক্তাদের উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে।’
স্বাস্থ্যখাতের বাজেট বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে তা প্রণয়ন করা যাচ্ছে না। এটি একটি মৌলিক ইস্যু, যেটিকে অবশ্যই সমন্বয় করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অংশীদারিত্ব জরুরি। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া দরকার। তবে এ খাতের নীতি বাস্তবায়নে যারা সংশ্লিষ্ট থাকবেন, তাদেরকে বিষয়টি নিয়ে আরও সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক তপন চৌধুরী।
আরও পড়ুন: পদোন্নতি বঞ্চিত ৮ হাজার চিকিৎসক-শিক্ষক, কী অভিযোগ?
‘বাংলাদেশ হেলথ কনক্লেভ ২০২৫’-এ স্বাস্থ্য-ওষুধ খাতের প্রবিধান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা খাত নিয়ে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. শামীম হায়দার। বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ কার্যালয়ের টিম লিডার সাংগে ওয়াংমো।
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম এবং বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন বিশ্বাস। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ন্যাশনাল টেলিহেলথ সার্ভিসের সিইও ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ।
]]>