বড় ভূমিকম্পের কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?

১ দিন আগে
সাম্প্রতিক সময়ে ঘনঘন মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্পন, বিশেষ করে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প এবং শনিবার ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় ও সন্ধ্যায় রাজধানীতে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হলো, তা আবারও সামনে নিয়ে এসেছে এক চরম উদ্বেগের চিত্র–বাংলাদেশ কি তবে একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে?

বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি কতটা–এই প্রশ্নটি এখন আর কেবল বৈজ্ঞানিক জল্পনা নয়, বরং এক জরুরি জাতীয় উদ্বেগের বিষয়। দেশের অবস্থান এবং ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তির সময়কাল বিবেচনা করে ভূতত্ত্ববিদরা সতর্ক করছেন যে, বাংলাদেশ একটি ‘সিসমিক টাইম বম্বের’ ওপর অবস্থান করছে।


আজ শনিবার ও গতকাল শুক্রবার এই অপেক্ষাকৃত ছোট মাত্রার ভূমিকম্পে দুর্বল ভবনের রেলিং ও পলেস্তারা খসে পড়া বৃহত্তর অবকাঠামোগত ঝুঁকির এক ক্ষুদ্র পূর্বাভাসমাত্র।


বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ভূ-গর্ভস্থ শক্তির কারণে যে কোনো মুহূর্তে ৭ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।


ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বাংলাদেশ অবস্থান করছে ইন্ডিয়ান, ইউরেশীয় ও বার্মিজ–এই তিনটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে। এই প্লেটগুলোর ক্রমাগত সরণের ফলে ভূ-অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে জানান, বাংলাদেশের সিলেট থেকে কক্সবাজার অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে বর্তমানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে।
 

আরও পড়ুন: শক্তিশালী ভূমিকম্পে দেশের কোন অঞ্চল বেশি ঝুঁকিতে, জানালো আবহাওয়া অধিদফতর


অধ্যাপক আখতার ব্যাখ্যা করেন, এই অঞ্চলে ‘লকড জোন’ (যেখানে ঘর্ষণশক্তি অনেক বেশি হওয়ায় প্লেটগুলো আটকে আছে) তৈরি হয়েছে। ৮০০ থেকে ১০০০ বছর আগে এই জোনে বড় ভূমিকম্প হয়ে শক্তি মুক্ত হয়েছিল। সেই শক্তি আবার নতুন করে সঞ্চিত হয়েছে এবং এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক।


শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, আজকের ৫.৭ মাত্রার কম্পনটি সেই সতর্কবার্তা দিচ্ছে যে, দীর্ঘদিন ধরে প্লেটের সংযোগস্থলে যে ‘লক’ বা আটকা অবস্থা ছিল, তা এখন খুলে যাচ্ছে; যা ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে আরও বড় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।


বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প সাধারণত প্রায় দেড় শতকের (১৫০ বছর) ব্যবধানে ফিরে আসে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৭৬২ সালে প্রায় ৮.৫ মাত্রার ‘গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক’ এবং ১৮৯৭ সালে আসামে আঘাত হেনেছিল ৮.৭ মাত্রার ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’, যার অভিঘাতে তৎকালীন বাংলা অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এরপর ১৯৩০ সালের ধুবড়ি ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.১। অধ্যাপক আখতারের মতে, ১৯৩০ সালের পর থেকে অপেক্ষাকৃত বড় কোনো ভূমিকম্প না হওয়ায় সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।


বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী মনে করেন, বড় ধরনের কম্পন সাধারণত দেড় শতকের (১৫০ বছর) ব্যবধানে ফিরে আসে। সেই হিসাবে আবারও ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি সামনে চলে এসেছে।


এদিকে, দূর অনুধাবন ও জিআইএস-এর পরিচালক (ভূতত্ত্ব), বিশেষজ্ঞ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মনে করেন, ডাউকি ফল্ট, মধুপুর ফল্ট এবং চট্টগ্রামের টেকটোনিক মুভমেন্টের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


অধ্যাপক আনসারী আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, ভূমিকম্পের মাত্রা যদি ৬-এর কাছাকাছি পৌঁছায়, তাহলেই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি সতর্ক করে বলেন, রাজধানীতে প্রায় ২১ লাখ ভবন রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ভবন ছয়তলার বেশি–বড় ধরনের কম্পন হলে এই উচ্চ ভবনগুলোর ওপরই সর্বাধিক ঝুঁকি তৈরি হবে।
 

আরও পড়ুন: এর চেয়েও বড় কম্পন কি সামলাতে পারবে ঢাকা?


রাজউকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। আজকের (শুক্রবার) স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পেও দুর্বল ভবনগুলোর রেলিং ও পলেস্তারা খসে পড়া তারই ইঙ্গিত।


ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৭৬২ সালের গ্রেট আরাকান আর্থকোয়াক (৮.৫) চট্টগ্রাম উপকূলে ভূমি দেবে দিয়ে সুনামি সৃষ্টি করেছিল। আবার ১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক (৮.৭) শিলং মালভূমিতে উৎপন্ন হলেও ঢাকা, সিলেটসহ পূর্ববঙ্গের সব অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংস ঘটিয়েছিল। এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, নিকটবর্তী অঞ্চলে সৃষ্ট বড় ভূমিকম্পও বাংলাদেশে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে।


বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলে তাতে প্রধান ফল্টগুলোতে সঞ্চিত বিশাল শক্তির কোনো মুক্তি ঘটে না। উল্টো, এটি মূল ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।


অধ্যাপক আনসারীর মতে, রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানার ভবনগুলো পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়া হলেও, রাজধানীর সব ভবনের কাঠামো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মিত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করা এখন জরুরি।


প্লেট মুভমেন্টের ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করা গেলেও বাংলাদেশে এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের অবকাঠামো এবং পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সুবিধা নেই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।


বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, সরকার ও জনগণ–উভয়কেই দ্রুত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ভূমিকম্পের মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করাই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উত্তম পন্থা।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন