প্লাস্টিকের বিষে নীল রাজধানী ঢাকা, মুক্তি মিলবে কবে?

১ সপ্তাহে আগে
প্রতিদিনের বাজার শেষে একগাদা পলিথিন ব্যাগ হাতে ঘরে ফেরেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবু তাহের (৬৫)। মাছ কিংবা মাংস অথবা আলু, পেঁয়াজ, টমেটো যাই কিনতে যান তিনি, দোকানিরা সেসব খাদ্যসামগ্রী পলিথিন ব্যাগে ভরে তার হাতে ধরিয়ে দেন।

আবু তাহের বলেন, ‘পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর; তাই আমি পলিথিনের বিপক্ষে। কিন্তু কী করব? আমাকে তো বাজার করতে গেলেই দোকানিরা হাতে পলিথিন ধরিয়ে দেন। অথচ পলিথিন নিয়ে বাড়ি ফিরতে আমার একদমই ভালো লাগে না।’

 

শুধু আবু তাহের নয়, এমন অনেক মানুষেরই অপছন্দ পলিথিন। তারপরও তাদের অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যবহার করতে হয় এ পলিথিন। কেননা বাংলাদেশের কাঁচাবাজার, মুদিদোকান, শপিংমল, চেইনশপসহ এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে না।

 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক ও পলিথিনজাতীয় পণ্যের ব্যবহার এতো বেশি যে তা নির্মূল করা বেশ কঠিন। খাদ্যদ্রব্য আনতে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে প্রায় সব জায়গাতেই ব্যবহার হচ্ছে এসব পণ্য।

 

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের। আর প্লাস্টিক উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। ২০ লাখেরও বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত।

 

ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিত্যক্ত হয়ে তা পুকুর, ডোবা, নদী-নালা ও সাগরে গিয়ে জমা হচ্ছে। কৃষকের চাষের জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট ভরে আছে প্লাস্টিক বর্জ্যে। ফলে পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব বর্জ্য।

 

এদিকে বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ৫ লাখ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হচ্ছে। যার মধ্যে বছরে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে গিয়ে পড়ে, ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে এর পরিমাণ হবে ১ লাখ ৩০ হাজার টন। বিশ্বব্যাপী মানুষ যে পরিমাণে প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করছে তাতে ২০৫০ সালে পৃথিবীর সমুদ্রে মাছের থেকে প্লাস্টিকের বোতল বা অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্য বেশি থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
 

ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিত্যক্ত হয়ে তা পুকুর, ডোবা, নদী-নালা ও সাগরে গিয়ে জমা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত


প্লাস্টিক পরিবেশের যেসব ক্ষতি করে
 

পৃথিবীতে প্রতি বছর ৪৫ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে। এ বর্জ্যের ৫১ শতাংশ উৎপাদন হচ্ছে এশিয়া মহাদেশে। প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন এবং দূষণে চীন পৃথিবীর সর্বোচ্চ অবস্থানে।


বাংলাদেশে প্রতিদিন আট লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, তার মধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ পুনর্চক্রায়ণ, ৩৯ ভাগ ভূমি ভরাট এবং বাকি ২৫ ভাগ সরাসরি পরিবেশে দূষক হিসেবে যোগ হচ্ছে। এসব পচনরোধী প্লাস্টিক বর্জ্য শতকরা ১০ ভাগ পুড়িয়ে ধ্বংস করা হলেও বাকি ৯০ শতাংশের বেশি বিশ্ব পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। এমনকি দেশের তিন বড় নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা থেকে প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক আসে।


দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার। রাজধানীতে বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, বাইরের শহরগুলোতে এর পরিমাণ মাথাপিছু ৩ কেজি। প্লাস্টিক বর্জ্য দেশের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে আটকে পানি ও প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদান চলাচলে বাধা দেয়। এতে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না, মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং শস্যের ফলন কম হয়।

 

২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় সুইজারল্যান্ডের গবেষকরা দেখিয়েছেন, প্লাস্টিক তৈরিতে ১০ হাজারের বেশি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৪০০টি মানুষের শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

 

প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সামুদ্রিক প্রতিবেশ। ফলে প্রতি বছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মৃত্যুবরণ করে। কেবল ক্ষুদ্র সামুদ্রিক প্রাণী নয়, বিশাল তিমি মাছও প্লাস্টিক দূষণে মারা পড়ছে। সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছের শরীরে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ সঞ্চিত হয়ে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।

 

বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, প্রতিদিন ৮০ লাখ টুকরা প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। এভাবে জমতে জমতে বড় বড় মহাসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা (প্যাচ) তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রশান্ত মহাসাগরে বর্তমানে প্লাস্টিক বর্জ্য প্যাচের আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। অনুরূপ প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা অন্যান্য মহাসাগর এবং সাগরেও সৃষ্টি হয়েছে। শুধু সমুদ্রের তলদেশ নয়, সমুদ্রের পানির উপর স্তরের প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ কম-বেশি প্লাস্টিক দূষণে দূষিত।

 

এ ছাড়া প্লাস্টিক অন্য রাসায়নিকও বহন করতে পারে, যা প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় না। ওই সব রায়াসনিক প্লাস্টিকের মাধ্যমে মিশে প্রবেশ করে মানব শরীরে। প্রতি বছর কোটি কোটি টন প্লাস্টিক মিশছে পরিবেশে। ফলে বিপুল পরিমাণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় ডুবছে গোটা বিশ্ব।

 

এমন অবস্থায় মানুষ কতটা আক্রান্ত হচ্ছে, কোন কোন সমস্যা তৈরি হচ্ছে এবং সমস্যার আকার কেমন, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই গবেষকদের। প্লাস্টিক দূষণের স্রোতের সঙ্গে তারাও পাল্লা দিয়ে ছুটছেন।

 

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০৬০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের উৎপাদন তিন গুণ বাড়বে সারা বিশ্বে। তাই দূষণ রোধ করার সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও কার্যকর উপায় হলো প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার হ্রাস করা। প্লাস্টিকবিরোধী চুক্তি সারা বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন কমাতে আইনগতভাবে সহায়ক হবে। সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার কারণে পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। প্লাস্টিক অপসারণের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার করা হলেও সেগুলো পরিবেশের জন্য উপযোগী নয়। তাই যান্ত্রিক উপায়ে এসব বর্জ্য পরিষ্কার করা যাবে না।

 

প্লাস্টিকজাতীয় পণ্যের সবচেয়ে ক্ষতিকর পলিথিন

 

প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। পৃথিবীজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক ব্যাগ আমরা ব্যবহারের পর ফেলে দিচ্ছি। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর মোট খনিজ তেলের ৪% ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিক ব্যাগ জৈব বিয়োজনশীল নয়। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পুড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ ও ১৩৪০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড মিশে।

 

এদিকে পরিবেশের জন্য ক্ষতি বিবেচনা করে প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশই সবার আগে পলিথিনকে আইন করে নিষিদ্ধ করেছিল। তবে বর্তমান সময়ে বাজারে পলিথিনের আধিপত্য দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই, ২৩ বছর আগেও নিষিদ্ধ ছিল এ পলিথিন।

 

অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে যখন পুরো বিশ্ব সংকটাপন্ন সময় কাটাচ্ছে তখন আমরা কিনা পলিথিনের মতো পণ্য থেকে শুল্ক কমিয়ে আনছি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটেই এমন প্রস্তাব ওঠে এসেছে। বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ ও মোড়ক সামগ্রীর ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে তা ১ দশমিক ৫ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে।

শুধু সমুদ্রের তলদেশ নয়, সমুদ্রের পানির উপর স্তরের প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ কম-বেশি প্লাস্টিক দূষণে দূষিত। ছবি: সংগৃহীত

 

যেখানে পুরো বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে সেখানে আমরা কিনা পরিবেশের বিপর্যয়ে ভূমিকা রাখা পণ্যে শুল্ক কমিয়ে আনছি। অথচ শুধু পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনলেই পরিবেশ, জলবায়ু ও মানুষ নানারকম ক্ষতিকর বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে পারে। তাই ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

 

আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগের অভাবে তা বাস্তবায়ন হয়নি।

 

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি করে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসাবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিনের ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হচ্ছে।

 

এসব বর্জ্য পোড়ালে কার্বন-মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে। পুরানো প্লাস্টিক পুড়িয়ে আবার নতুন পণ্য তৈরি করা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ডাস্টবিনে ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্য বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে চলে যায়, যে কারণে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এসব বর্জ্যের জন্য ধ্বংস হচ্ছে সমুদ্রের জীবনবৈচিত্র্যও।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বলছে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিনের ব্যাগ জমা হচ্ছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাজধানীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় প্লাস্টিকের কারখানা আছে প্রায় কয়েকশ’। লালবাগের চান্দিরঘাট এলাকাতে ঘুরে দেখা যায়, পুরোটাই প্লাস্টিক উৎপাদনের কারখানা। এখানে প্রকাশ্যে চলে অবৈধ পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি। অথচ এ পলিথিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।

 

পলিথিন যেসব ক্ষতি করে

 

বায়ুদূষণে ঢাকা শহর মাঝেমধ্যেই প্রথম বা দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে। বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায়ও এই শহরের অবস্থান তলানিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী পরিবেশদূষণ। আর পরিবেশদূষণের যেসব কারণ আছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পলিথিন। পলিথিন মাটি, পানি, বায়ুকে সমানভাবে দূষিত করে।

 

পলিথিন মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদান চলাচলে বাধা দেয়। মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না, জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায় এবং শস্যের ফলন কম হয়। পলিথিনের জন্য সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। পুরোনো পলিথিন পুড়িয়ে আবার পলিথিন তৈরি করা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

 

সমুদ্রসম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রেও দায়ী পলিথিন। ইতোমধ্যে একাধিক গবেষণায় লবণে এবং মাছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। আমরা যে পলিথিন ব্যবহার করি, তা নগর বন্যার জন্যও কম দায়ী নয়। এ পলিথিন নদী হয়ে সাগরে যায়। এ প্রক্রিয়ায় সাগর দূষণে বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে আছে বলে গবেষণা বলছে।

 

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর ৮০ শতাংশ পলিথিনই মাটিতে ফেলা হচ্ছে। বছরে ১৭ হাজার টন পাতলা প্লাস্টিক ও পলিথিন মাটিতে পড়ছে। যার ৭৩ শতাংশ মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ফলে পলিথিন ইতোমধ্যে খাদ্য শৃঙ্খলের মধ্যেও চলে এসেছে।


কী বলছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা?

 

প্লাস্টিক ও পলিথিনজাতীয় পণ্যের ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যা ভবিষ্যতে মানবজাতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই প্লাস্টিক দূষণ হ্রাস করার জন্য সময়োপযোগী আইন তৈরি, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিকর দিক ও করণীয় সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে বলে অভিমত দেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।

 

এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, ‘২০০৫ সালে দেশে বছরে জনপ্রতি প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ কেজি। একটা প্লাস্টিক বোতল ১ হাজার বছর, পলিব্যাগ ৪৫০ বছর ও প্লাস্টিকের স্ট্র ৭০০ বছর টিকে থাকতে পারে। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ২০ লাখ টন প্লাস্টিক বিভিন্ন সমুদ্রে যাচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতি বছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি ও ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। এর মূল কারণ প্লাস্টিকের দাম ও সহজলভ্যতা।’

 

তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করছি প্লাস্টিক সস্তা। কিন্তু লবণ, চিনি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আমার-আপনার পেটের ভেতরেও প্লাস্টিক প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মায়ের দুধেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কম দামের প্লাস্টিকে সাময়িক লাভ হয়তো হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির পরিমাণই বেশি।’

 

রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণের বড় উৎস একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক। পাতলা প্লাস্টিকের মোড়ক, কফির কাপ, ঢাকনা ও চামচ, স্ট্র ও পলিথিন ব্যাগ– এসব কিছুই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক। দেশে এসব প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। কিছু প্লাস্টিক রিসাইকেল হলেও তার মা-বাবা নেই। এই রিসাইকেলে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো কে তদারকি করছে?

 

কোনো কোনো গবেষণা বলছে, রিসাইকেল প্লাস্টিকের রাসায়নিক আরও বেশি ভয়ানক হতে পারে। পরিবেশ অধিদফতর কি এই রিসাইকেলের সনদ দিচ্ছে? বিএসটিআই কি কোনো মানমাত্রা নির্ধারণ করেছে? ফলে যে প্লাস্টিক এখন রিসাইকেল হচ্ছে, সেগুলোর মান ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রিসাইকেল-বিষয়ক নীতিমালা হওয়া জরুরি।

 

 

 

তবে দেশেই একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের যথেষ্ট বিকল্প রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেশি দায়িত্ব উৎপাদকদেরই নিতে হবে। ভোক্তাদের আচরণে বদল আনাও তাদের দায়িত্ব। তাদের প্লাস্টিকের বিকল্প দিতে হবে এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাদা আইন প্রয়োজন। একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনের ব্যাগের পরিবর্তে হাটবাজারে ও পণ্যের প্যাকেজিংয়ে পরিবেশবান্ধব দেশীয় উপাদান যেমন– পাট, কাপড় ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা পাবে, অন্যদিকে দেশীয় পণ্যের প্রসার ঘটবে।’

 

এদিকে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সরকার উল্টো পথে হাঁটছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একসময় প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পলিথিন ব্যাগে এখন বাজারভর্তি। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। বাজার তদারকিও নেই। আমাদের আইনে বলা আছে, ১৪টি পণ্যে পলিথিন প্যাকেট দেয়া যাবে না। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ থাকে একেবারেই অপ্রতুল।‘

 

তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। পলিথিন ১০০ বছরেও পচে না। এ সময়ে এটি মাটির যেখানেই থাকে, সেখানেই ক্ষতি করে। এ কারণে উর্বরতা কমে ফসলের ফলন কমায়। পলিথিনে আটকে যায় পাখি ও মাছ। অনেক সময় মাছের পেটেও প্লাস্টিক পাওয়ার খবর শোনা যায়। সাগর থেকে আহরিত লবণেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর পোড়ালে তা বায়ুদূষিত করে। সবমিলে পলিথিন এক ভয়ংকর বস্তুর নাম।

 

তাই সারা বিশ্বের উচিত পলিথিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। বিষয়টি উপলব্ধি করে দুই দশক আগেই বাংলাদেশ এর ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন করেছে। তিনি পলিথিনের পরিবর্তে এর বিকল্প পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা দেয়ার পরামর্শ দেন সাইফুল ইসলাম।

 

সমাধান কোন পথে?

 

প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা তৈরি করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এই সময়ের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা, প্লাস্টিক বর্জ্য ৩০ শতাংশ কমানো এবং ২০২৬ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের পুনঃব্যবহার ৫০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা হয়।

 

পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটাগুলোর হালনাগাদ অবস্থা, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার বন্ধে নেয়া কার্যক্রম এবং পরিবেশ দূষণ সম্পর্কিত এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে চলতি বছরের গত ৩ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

 

পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ জেলার সব সরকারি অফিস এবং উপকূলীয় এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ রোধকল্পে মাসিক সভা ও অংশীজনদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনা সভা এবং  জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।

 

এদিকে একবার ব্যবহার উপযোগী পণ্য বন্ধে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর পরিকল্পনা তৈরি করা ইতিবাচক। তবে পরিকল্পনা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা জরুরি। পাশাপাশি নিজ নিজ জায়গা থেকেও প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতন হওয়া উচিত।

সরকারের এসব উদ্যোগ যদি বাস্তবায়ন করা যায় এবং যার যার জায়গা থেকে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে সচেতন হওয়া যায় তাহলে পরিবেশের কঠিন বিপর্যয় থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন