১৯৭৫ সালে সেনা অভ্যুত্থানে তার বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হওয়ার পর হঠাৎ করেই তিনি রাজনৈতিকভাবে সামনে আসেন। শুরুর দিকে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করলেও পরের দীর্ঘ শাসনকাল গণতন্ত্র হরণের জন্য নিন্দিত হয়েছে। বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার, বাকস্বাধীনতা সংকোচন ও ভিন্নমত দমনের একের পর অভিযোগে তার সেই সংগ্রাম চাপা পড়ে গেছে।
ছাত্র আন্দোলনের মুখে গতবছর আগস্টে পদত্যাগ করে পাশের দেশে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ১৫ মাস পর আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ডও দিল।
ছাত্রনেতৃত্ব থেকে প্রধানমন্ত্রিত্ব
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের শুরু ষাটের দশকে ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে।
১৯৬৬-৬৭ সালে ছাত্রলীগ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালে ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৬৬ সালে ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে বিজয়ী শেখ হাসিনা
আরও পড়ুন: সিনার ফাঁসির রায়: স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে যে বার্তা দিলো বিএনপি
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ই শেখ হাসিনা তার মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বোন শেখ রেহানা ও ছোট ভাই শেখ রাসেলের সঙ্গে ঢাকায় বন্দি ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য যখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে, হাসিনা তখন স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়ার জার্মানির কর্মসূত্রে বেলজিয়ামে অবস্থান করছিলেন। শেখ রেহানাও তার সঙ্গে ছিলেন।
এরপর দীর্ঘ সময় দেশে ফিরতে পারেননি শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার অনুপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তাকে দলীয় প্রধান নির্বাচিত করা হয়। ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন তিনি।
শেখ হাসিনা, ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিসহ রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে জয়ী হয়।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই দলীয় প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ।
২০০১ সালে অক্টোবরে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটের কাছে হেরে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলার আগ মুহূর্তে শেখ হাসিনা।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন শেখ হাসিনা। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হামলাটি হয় ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট। গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জনের প্রাণ যায়। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গণতন্ত্রের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে এক কাতারে লড়েছিলেন
ক্ষমতায় চরম সমালোচিত হলেও ১৭ কোটি মানুষের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো এবং তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যাপক সম্প্রসারণের জন্য কৃতিত্ব পেয়ে আসছিলেন হাসিনা। মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় আন্তর্জাতিক মহল থেকেও তিনি প্রশংসিত হন।
কিন্তু সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা নিয়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে তার পতন হলো, যে আন্দোলনটি দ্রুতই তার পদত্যাগের দাবিতে ব্যাপক গণবিক্ষোভে রূপ নিয়েছিল। পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাত্র সাত মাসের মধ্যেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
ভারতে নির্বাসন থেকে হাসিনা মানবতাবিরোধী অভিযোগ অস্বীকার করে এই রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘সঠিক ও নিরপেক্ষ আদালতে বিচার হলে আমি অভিযোগকারীদের সামনে দাঁড়াতে ভয় পাই না।’
রাষ্ট্রনিযুক্ত তার আইনজীবীও আদালতে অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।
জাতিসংঘের ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সর্বোচ্চ ১,৪০০ মানুষ নিহত হতে পারে এবং সরকারি নির্দেশেই বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা ও দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে—এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিষ্ঠিত এবং হাসিনার আমলে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই এবার তার রাজনৈতিক জীবনে নাটকীয় মোড় এনে দিল। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের সময় ইউরোপে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি, সেই থেকেই তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে যা বলল জাতিসংঘ
১৯৪৭ সালে গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া হাসিনা শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুন্নেছার পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে ডিগ্রি নেয়ার পর তিনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তার বাবার যোগাযোগের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
পঁচাত্তরের অভ্যুত্থানের পর ভারতে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থেকে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন হাসিনা। ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে হটাতে কট্টর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার সঙ্গে মিলে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। তবে এ মিলন বেশিদিন টেকেনি। ‘বেগমদের দ্বন্দ্ব’ নামে পরিচিত দুই নেত্রীর তিক্ত লড়াই পরবর্তী কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ রাজনীতিকে বিভক্ত করে দেয়।
১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন হাসিনা। পাঁচ বছর পর বিরতি দিয়ে ২০০৯ সালে ফের ক্ষমতায় ফিরে টানা চার মেয়াদ দেশ চালান।
অভিযোগ, পতন ও নির্বাসন
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসনের অভিযোগ বাড়তে থাকে। বিরোধী নেতা ও কর্মীদের গণগ্রেফতার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা— এসবই তাঁর শাসনের ‘অন্ধকার দিক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, দেশটিতে কার্যত একদলীয় শাসন কায়েম হয়। তবে হাসিনার দাবি ছিল— স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থেই শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দী হন। তাঁর দল অভিযোগ করে, হাসিনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব মামলা করেছেন। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর খালেদা জিয়া মুক্তি পান। উভয় নেত্রী একে অপরকে গণতন্ত্রকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করতেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের একসময়ের দ্রুতগতির অর্থনীতি গতি হারায়। ফলে গত বছর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ নিতে হয়।
আরও পড়ুন: মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার নিয়ে যে বার্তা দিলেন ফয়েজ তৈয়্যব
গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানের মুখে সেনা হেলিকপ্টারে বোনকে নিয়ে দেশ ছাড়ার পর হাসিনার পতন চূড়ান্ত হয়। এরপর উল্লসিত বিক্ষোভকারীরা কোনো বাধা ছাড়াই তার বাসভবন গণভবনে প্রবেশ করে আসবাবপত্র ও টেলিভিশনসহ নানা সামগ্রী লুটে নিয়ে যায়।
এরপর থেকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তিনি হাসিনার সমালোচনার লক্ষ্য ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে এবং হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিতও হয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারির শুরুতে যে জাতীয় নির্বাচনের কথা রয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না—এমন ঘোষণা দিয়েছেন ইউনূস।

১ সপ্তাহে আগে
৪






Bengali (BD) ·
English (US) ·