বাহ্যিকভাবে এটি এক টুকরো কাপড়ের গল্প হলেও ভেতরে গভীর আধ্যাত্মিক সত্য লুকানো রয়েছে। আর এই সত্যটাকে আমরা যত গভীরভাবে দেখি, ততই বুঝতে পারি সেলফ কনটেন্টমেন্ট, ন্যায়বোধ, প্রেম এবং সৃষ্টিকর্তার দিকনির্দেশনা মানুষের জীবনে কীভাবে কাজ করে।
ওয়ায়েস করনী ইয়েমেনের ক্বারন গোত্রের এক দরিদ্র অখ্যাত যুবক। চেহারা-চরিত্রে বা সামাজিক অবস্থানে এমন কিছুই ছিল না যার কারণে তাকে কেউ বিশেষ গণ্য মনে করবে। তার একটি পরিচয়ই ইতিহাসে অমর হয়েছে। মায়ের সেবায় নিবেদিত একজন মানুষ। তিনি মাকে রেখে নবীজির দরবারে যেতে পারেননি।
জীবনে কখনো রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর সাথে দেখা হয়নি। কিন্তু দেখা না হওয়ার মধ্যেই তার প্রেমের প্রকৃত গভীরতা ফুটে উঠে নবীজি তাকে চিনেছেন, না দেখেও। তিনি মূল্য দিয়েছেন, সাক্ষাৎ না হয়েও। আর নিয়তি তাকে বানিয়েছে তাবেঈনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত এক নাম। এখানে একটা দারুণ বিরোধও আছে। ওয়ায়েস কারও চোখে ছিলেন না, কিন্তু খোদাবন্দের নিকট এতটাই প্রিয় ছিলেন যে নবীজি নিজের মৃত্যুর আগে হযরত উমর (রা.) ও আলী (রা.)–কে নির্দেশ দিয়ে গেলেন,
ওয়ায়েস করনীকে খুঁজে বের করবে। আর আমার জুব্বা তাকে হাদিয়া দিয়ে দেবে। হাদিয়ার এই ব্যাপারটা মূলত ছিল আধ্যাত্মিক আমানত। নবীজির জুব্বা মোবারক এমন কারও কাছে যাবে, যে কখনো দরবারে দাঁড়ায়নি, কাউকে তৃপ্ত করতে লেখেনি, কারও ক্ষমতার ভরসায় জয় লাভ করেনি। বরং আনুগত্য, প্রেম ও ন্যায়ের ঐশ্বরিক সংযোগে দাঁড়িয়েছিল।
এটাই মানুষের আসল প্রশ্নের জায়গা। মানুষ কি খ্যাতিতে বাঁচে? মানুষ কি ক্ষমতার স্নিগ্ধ ছায়ায় বাঁচে? মানুষ কি আর্থিক নিরাপত্তায় বাঁচে? না। মানুষ বাঁচে তার অন্তরের সত্যে, তার মানসিক ন্যায়বোধে, তার আত্মার সংযোগে।
আরও পড়ুন: নবীজির প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে মুফতি আবদুল্লাহ তামিমের অনন্য সিরাত গ্রন্থ ‘নবীজির প্রিয় ১০০’
ওয়ায়েস করনীর জীবনে ছিল দারিদ্র্য। ছিল না কোনো অবস্থান, ছিল না কোনো রাজনৈতিক পরিচয়, কোনো লেখকের অহং, বা নৈতিক দাবির উচ্চবাচ্যতা। কিন্তু ছিল সেই আত্মার পরিপূর্ণতা, যার জন্য সেলফ কনটেন্টমেন্টকে পৃথিবী কখনোই ছিনিয়ে নিতে পারে না। তাই তিনি ছিলেন না বিভ্রান্ত, না হতাশ, না আত্মবিরোধী। ইতিহাসের অন্য প্রান্তে আমরা দেখি যারা অন্যায়ের পাশে দাঁড়ায়, যারা সত্যকে ভুল পথে ব্যাখ্যা করে, যারা সেলফ কনটেন্টমেন্টের জগৎ থেকে ধীরে ধীরে নির্বাসিত হয় তাদের অন্তরে শূন্যতা জন্মায়, যা কোনো সম্পদ, কোনো ক্ষমতা, কোনো প্রশস্ত সম্মানপত্র দিয়ে ভরানো যায় না।
ওখানে শুরু হয় ডিলিউশন। সত্য মনে হয় মিথ্যা, আর মিথ্যাকে মনে হয় সত্য। ওয়ায়েসের গল্প আমাদের বলে, খোদাবন্দ যখন বান্দার উপর দয়া করেন, প্রথমেই তাকে সত্য–মিথ্যার পার্থক্য চেনার আলো দেন। আর যখন সেই আলো কেড়ে নেন, তখন মানুষ নিজের ভেতরকার গাইডেন্স হারিয়ে ফেলে।
একদিকে সে মনে করে সে ঠিক, অন্যদিকে তার হৃদয় প্রতিদিন ফাঁকা হয়ে যায়। ধরুন, ওয়ায়েস করনী যদি ক্ষমতার ঘনিষ্ঠতার দিকে ছুটতেন, যদি কোনো শাসকের তোষামে ফিতনা হয়ে যেতেন, যদি নিজের ন্যায়কে ছেড়ে রাজনৈতিক ন্যায়ের ভানে বাঁচতেন, তাহলে কি তিনি এই জুব্বার প্রকৃত যোগ্য হন? না। কারণ নবীজি কাউকে তার বাহ্যিক ক্ষমতা দেখে জুব্বা দেননি। প্রদানের ভিত্তি ছিল তাকওয়া, সত্য, মায়ের সেবা, আত্মার পরিষ্কারত্ব এবং রাসূল প্রেম।
আজকের পৃথিবীতে আমরা সত্যিকারের সেই আলোকে প্রায় ভুলেই গেছি। জ্ঞানী মানুষ অহংকারে ডুবে আছে, সৎ মানুষ নিরাশায় ডুবে আছে, আর ক্ষমতার সান্নিধ্য পাওয়া মানুষরা সত্যের আলো হারিয়ে ফেলেছে। ওয়ায়েস করনী সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলছেন, দুনিয়ার স্বীকৃতি নয়, আত্মার পবিত্রতা মানুষের প্রকৃত মহিমা।
হযরত উমর (রা.) যখন তাকে জুব্বা মোবারক দিতে গেলেন, তখন ওয়ায়েস বলে উঠলেন তোমরা কারা যারা আমার সন্ধান করছো? জবাবে ওমর (রা.) বললেন, আমি ওমর। রাসূল (সা.)- এর দরবার থেকে এসেছি। হুজুর পাক (সা.) ইন্তেকালের পূর্বে বলে গেছেন যেই জুব্বাটি গায়ে দিয়ে রাসূল উর্ধ্বগমন করেছেন সেই জুব্বাটি যেন আপনার নিকট হাদিয়া স্বরুপ পৌঁছে দেওয়া হয়।
ওয়ায়েস করনী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় বললেন, তোমরা যখন আমার দুয়ারে হাজির হয়েছো, আমার নাকে কেমন জানি নবীজির ঘ্রান আসতেছিল। তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং কেঁদে দিলেন। কারণ তিনি জানতেন, এ আমানত তার দেহে পরার কাপড় নয়। এটি তার হৃদয়ের আলোকে নবীর পরীক্ষা।
সত্য ধরে রাখলে এই আলো বাঁচে, সত্য হারালে এই আলো নিভে যায়। এখানেই ওয়ায়েস করনী আমাদের শেখায় আত্মার জার্নিতে মস্তিষ্ক কম পড়ে, যদি না সৃষ্টিকর্তার দিকনির্দেশনা থাকে। ন্যায়বোধ জন্মায় হৃদয়ে, মাথায় নয়। সেলফ কনটেন্টমেন্ট জন্মায় সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে, ক্ষমতা বা প্রশংসার ওপর নয়।
আমরা বেঁচে থাকি ওই আলোয় যতটুকু রহমত বরাদ্দ আছে ততটুকু নিয়ে। ওয়ায়েস করনীর আলোর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, যে মানুষ সত্যের জার্নিতে নিবেদিত, তাকে পৃথিবী চুপচাপ শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে দেয়।
লেখক ও গল্পকার

১ দিন আগে
১








Bengali (BD) ·
English (US) ·