সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের আলীপুর গ্রাম থেকে স্বজনপুর গ্রামের ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পিয়াইন নদীতে রয়েছে অসংখ্য বাঁশের ভেলা। পিয়াইন নদীর একপাড়ে জামালগঞ্জের পাকনার হাওড় অন্যপাড়ে দিরাই উপজেলার কালিয়াকোটা হাওর। দুই হাওড়েই দুই উপজেলার কয়েক হাজার কৃষকের জমি রয়েছে। জমি চাষের জন্যে অবাধে অর্থ ও সময় বাঁচাতে শতবছর আগে প্রচলন হয় বাঁশের ভেলার।
গ্রামবাসীর নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিবছর কার্তিক মাসে মাত্র ৬ হাজার টাকা খরচ করে ১৪ হাত লম্বা ও আড়াই হাত প্রস্তের বাঁশের ভেলা নির্মাণ করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এ পাড় থেকে অপার যাতায়াতের জন্য উভয় পাশে ১০০ হাত করে প্লাস্টিকের রশি দিয়ে ভেলার দুই প্রান্ত শক্তপোক্ত করে বেধে নদীর দুই তীরে খুঁটিতে আটকে দেয়া হয়। যাতে মাঝি মাল্লা ছাড়া লোকজন নদীর এপাড় থেকে ওপাড়ে চলাচল করতে পারেন। সে সময়ের স্বশিক্ষিত কৃষকরা নিজস্ব মেধা-মনন আর দেশীয় প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তৈরি করেন এই বাঁশের ভেলা। কলাগাছের তৈরি ভেলা দীর্ঘদিন পানিতে থাকলে পচে গলে যাবে তাছাড়া ৫ থেকে ৬ জন লোক ধারণ করতে পারবে না। যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে।
কলাগাছের তৈরি ভেলা থেকে বাঁশের ভেলা টেকসই ও কার্যকর। দীর্ঘদিন বাঁশ পানিতে ডুবে থাকলে বাঁশের কোন ক্ষতি হয় না। সহজে রশির বাঁধ ছিঁড়ে বাঁশের ভেলা বিধ্বস্ত হবে না। এমন ভেবেই গ্রামের প্রবীণরা নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রচলন করেন বাঁশের ভেলার। এই ভেলা দিয়ে অনায়াসে গবাদিপশু মানুষ সারের বস্তা, বীজধানের বস্তা, লাঙল জোয়াল মই পরিবহন করে এপাড় থেকে ওপাড়ে নিয়ে যায় কৃষক। নেই কোনো জ্বালানি ও মাঝির খরচ। পরিবেশ প্রকৃতিবান্দব বাঁশের ভেলা দিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা রশি টেনে চলাচল করা যায়। পার করে দেয়ার জন্য বাড়তি কোনো মানুষ লাগে না।
শতবছর আগে খাগাউড়া গ্রামের কৃষকরা এই ভেলার প্রচলন শুরু করলেও ক্রমশ এটি বাংলাবাজার ও ভাটিপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ছড়িয়ে যায়। কার্তিক মাস থেকে জৈষ্ঠ্য মাস নদীতে পাহাড়ি ঢলের পানি আসার আগে পর্যন্ত পিয়াইন নদীর তীরবর্তী বাংলাবাজার, খাগাউড়া, সিচনী, গাজীরগাঁও, সিচনি, কুচিরগাঁও ইসলামপুর, আলীনগরসহ ২০ গ্রামের কয়েক হাজার হাজার কৃষক হাওরে বোরো আবাদের জন্য চলাচল করেন।
আরও পড়ুন: নেই সেতু: ১৪ বছর ধরে ভেলায় চড়েই স্কুলে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা
খাগাউড়া গ্রামের প্রবীণ নিখিল তালুকদার বলেন, বাপদাদার আমলে এই ভেলার প্রচলন শুরু হয়। প্রতি বছর গ্রামবাসীর উদ্যোগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাঁশের ভেলা নির্মাণ করে গ্রামের সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানে স্থাপন করা হয়। বছরের ৮ মাস তারা এটি ব্যবহার করেন। প্রতিটি ভেলা তৈরিতে ১৫টি পুক্তবাশ ও ২০০ হাত রশি লাগে।এসব উপকরণের বাজার দর ৫ হাজার টাকা।
একই গ্রামের ১১০ বছরের সবচেয়ে প্রবীন দ্বারকানাথ মজুমদার বলেন, এটি আমাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য। তখন নদীতে সেতু ছিল না। কেউ সেতুর কথা কল্পনাও করেনি। পুরো নদী জুড়ে সেতু বানাতে হলে ৫০ টি সেতুর প্রয়োজন হবে। তাই গ্রামবাসীর লোকায়ত জ্ঞান কলাভেলা থেকে টেকসই বাঁশের ভেলা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। তখন পাটের রশি দিয়ে দুই পাড়ে ভেলা বাধা থাকতো এখন পাটের পরিবর্তে প্লাস্টিকের রশি ব্যবহার করা হয়। এটি ডুবে ডুবে চলতে পারে তবে তলিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। অদক্ষ চালকের হাতে পড়লে রশি প্যাচ লেগে নদীর মধ্যে আটকে যেতে পারে ভেলা। একটি নির্দিষ্ট কায়দা করে রশি টানতে হয়। বেশি জোরে টানলে প্যাঁচানোর সম্ভাবনা থাকে।
আলীপুর গ্রামের মোতালেব মিয়া বলেন, বাংলাবাজার এর হাটবারে প্রতিটি ভেলায় শতশত মানুষ নদী পাড় হয়ে বাজারে আসেন আবার বাজার করে বাড়ি ফিরে যান।
রফিনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শৈলেন্দ্র কুমার তালুকদার বলেন, বাঁশের ভেলা আমরা ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি। আমরা নিজেও ভেলা দিয়ে নদী পাড় হয়ে ক্ষেতখামারে গিয়েছি। এখনো ছোট ছোট শিশুরা তাদের বাপ চাচার জন্য ভেলায় চড়ে হাওরে ভাত নিয়ে যায়। ছোট ছোট ভেড়া বাছুর ছাগল অনায়াসে পার হয়ে যায়। বাঁশের ভেলা পরিবেশ প্রকৃতি ও নদীর কোন ক্ষতি করে না। পানি দূষণ করে না। এটি কৃষি ও কৃষকবান্দব নৌযান। ভেলায় সময় কেটে গেলে ব্যবহৃত বাঁশগুলো খুলে ঘরের খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।