পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংঘর্ষের কারণ কী, কতদূর গড়াবে?

১ সপ্তাহে আগে
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তের বেশ কয়েকটি স্থানে উভয় দেশের বাহিনীর মধ্যে সংঘাত শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সংঘাতে উভয় পক্ষই একের অপরের সীমান্তবর্তী সেনাচৌকি দখল ও ধ্বংসের দাবি করেছে। করেছে সেনা হত্যার দাবিও।

আফগানিস্তানের তালেবান প্রশাসনের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ আজ রোববার দাবি করেছেন, শনিবার (১১ অক্টোবর) রাতে তাদের বাহিনীর ‘প্রতিশোধমূলক’ হামলায় অন্তত ৫৮ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে।

 

আফগান রাজধানী কাবুল ও দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় পাকতিয়া প্রদেশে বিস্ফোরণের খবরের দুদিন পর এ হামলা চালানো হয়। গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) রাতের ওই বিস্ফোরণের জন্য শুক্রবার (১০ অক্টোবর) পাকিস্তানকে দায়ী করে বিবৃতি দেয় আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে পাকিস্তান এই দাবি নাকচও করেনি আবার নিশ্চিতও করেনি।

 

এদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্বীকার করে বলেছে যে, তাদের ২৩ জন সেনা মারা গেছে। তবে পাল্টা হামলায় ২০০ তালিবান ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘সন্ত্রাসী’কে হত্যার দাবি করেছে। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আফগান বাহিনীর হামলাকে ‘বিনা উসকানিতে গুলি’ বলে অভিহিত করে।

 

আরও পড়ুন: ভারত থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত স্থগিতের ঘোষণা আফগান মন্ত্রীর

 

১৯৯৬ সালে তালিবান যখন আফগানিস্তানে প্রথমবার সরকার গঠন করে, তখন বিশ্বের যে তিনটি দেশ তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল তাদের অন্যতম ছিল পাকিস্তান। এরপর ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর আগ্রাসন শুরু হলে প্রায় দুই দশকের যুদ্ধে ইসলামাবাদ তালেবানকে সহায়তা করেছিল বলে অভিযোগ আছে।

 

তবে ২০২১ সালে তালিবান ফের ক্ষমতায় ফেরার পর পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা পেলে প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয়। ইসলামাবাদের অভিযোগ, তালিবান প্রশাসন পাকিস্তানের নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান (টিটিপি) সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। তবে এই অভিযোগ করে আসছে তালিবান।

 

অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের মধ্যে দেশ দুটির সেনারা সম্প্রতি সীমান্তে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। সবশেষ চলতি সপ্তাহে আরও একবার রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেখল বিশ্ব। প্রশ্ন হলো- হঠাৎ কেন এই সংঘর্ষ? পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে?  

 

কেন এই সংঘাত?

 

গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) রাতে হঠাৎ দুটি বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে আফগান রাজধানী কাবুল। এখানেই শেষ নয়, কয়েকশ’ কিলোমিটার দূরে আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশের সীমান্তবর্তী একটি বাজারের আরও একটি বিস্ফোরণ ঘটে।

 

ওই বিস্ফোরণের জন্য তালিবান সরকার পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে বলে, পাকিস্তান আফগানিস্তানের ‘সার্বভৌম ভূখণ্ড’ লঙ্ঘন করেছে। ইসলামাবাদ বিস্ফোরণের কথা সরাসরি অস্বীকার করেনি। 

 

তবে একজন পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, কাবুলে বিমান হামলা চালানো হয়েছিল এবং লক্ষ্যবস্তু ছিল টিটিপির নেতা নুর ওয়ালি মেহসুদ, যিনি একটি গাড়িতে ছিলেন। আল জাজিরা জানিয়েছে, টিটিপি নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ বেঁচে আছেন কিনা তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।

 

একসময় পারস্পরিক নিরাপত্তা রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করেছে পাকিস্তান ও তালেবান। কিন্তু ইসলামাবাদ যখন থেকে তালেবানের বিরুদ্ধে টিটিপির নেতাদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ তুলেছে, তখন থেকেই সম্পর্ক বৈরী হয়েছে। সংগঠনটির হামলায় পাকিস্তানে বহু প্রাণও গেছে।

 

আরও পড়ুন: পাক-আফগান সংঘাত নিয়ে কী বললেন তালেবান মন্ত্রী

 

ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা অধ্যয়ন ও গবেষণা কেন্দ্রের (সিআরএএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে টিটিপির হামলায় অন্তত ২ হাজার ৪১৪ জন নিহত হয়েছেন। বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকলে পাকিস্তানের জন্য ২০২৫ সাল হবে অন্যতম প্রাণঘাতী বছর। ২০২৪ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৪৬ জন।

 

সশস্ত্র হামলা শুরু হয় মূলত ২০২২ সাল থেকে। ওই বছর ক্ষমতাচ্যুত হন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ক্ষমতায় থাকাকালে ইমরান তালেবানের মধ্যস্থতায় টিটিপিকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছিলেন। 

 

পরবর্তীতে সেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেলেও হামলার পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। সম্প্রতি সম্পর্ক আরও অবনতি হয়। এর কারণ ইসলামাবাদ আফগানিস্তানের ভেতরে বিমান হামলা বাড়িয়েছে। এসব হামলার লক্ষ্যবস্তু টিটিপি যোদ্ধাদের ঘাঁটি বলে দাবি করা হচ্ছে।



উভয়পক্ষ যা বলছে

 

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ আফগানিস্তানের শনিবারের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভি তালেবানের হামলাকে ‘অযৌক্তিক’ অভিহিত করে বলেছেন, ‘তারা বেসামরিক লোকের ওপর গুলি ছুঁড়েছে। যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আফগানিস্তান রক্ত নিয়ে খেলা করছে।’

 

অপরদিকে আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইনায়াতুল্লাহ খাওয়ারিজমি এক এক্স পোস্টে লিখেছেন, ‘আফগান ভূখণ্ডে পাকিস্তানের বিমান হামলার পাল্টা জবাব দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান যদি ফের আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের মতো কিছু করে তাহলে আরও কঠোরভাবে জবাব দেয়া হবে।’ 

 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যা বলছে

 

পাকিস্তান-আফগানিস্তানের এই সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত বদলের আরেকটি উদাহরণ। ফলে এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি উভয় দেশকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা উভয় পক্ষের সংযম চাই। সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকলে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাতেও অবদান রাখবে।’

 

সংযমের আহ্বান জানিয়েছে কাতার ও সৌদি আরব। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয় পক্ষকে সংলাপ ও কূটনৈতিক পন্থা বেছে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি বর্তমানে ভারত সফর করছেন। তবে সীমান্তে উত্তেজনা নিয়ে নয়াদিল্লি এখনও কোনো মন্তব্য করেনি। ইসলামাবাদ তালেবানের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ককে সন্দেহের চোখে দেখছে।

 

পরিস্থিতির কি আরও অবনতি হবে?

 

পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি আসিফ দুররানি মনে করেন, এই সংঘাত বড় বা গুরুতর কিছুতে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ আফগানিস্তানের তুলনায় পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা অনেক বেশি।

 

আসিফ দুররানি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি যতই সংকটময় হোক না কেন, কূটনীতির পথকে সবসময় গুরুত্ব দেয়া উচিত। দুই দেশের সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান)। আফগান সরকার নিজেদের ভূখণ্ডে টিটিপির উপস্থিতির কথা স্বীকার করছে না। ফলে এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সম্পর্কে উত্তেজনা থাকেই যাবে।’

 

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

]]>
সম্পূর্ণ পড়ুন