সরেজমিনে সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ও নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের পদ্মার চর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে ক্ষেত থেকে ভুট্টা তোলা থেকে শুরু করে মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। কেউ নিজেদের ক্ষেত থেকে ভুট্টা তোলায় ব্যস্ত, আবার কেউ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে কাজ করে যাচ্ছেন নারীরাও। কৃষকদের পাশাপাশি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তীব্র রোদে ক্ষেত থেকে ভুট্টা তুলছেন নারী কৃষাণীরা। এরপর তা মাড়াই মেশিনের মাধ্যমে আলাদা করে রোদে শুকাচ্ছেন সবাই।
চর এলাকায় এ বছর প্রায় ৪০ বিঘা (প্রতি বিঘা ৫২ শতাংশ) জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন ডিক্রিরচর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য রুবেল মিয়া। এসব জমির অধিকাংশ মৌসুমী অনুযায়ী চুক্তিতে নেয়া। গত ১০ বছর পূর্বে তিনিই সর্বপ্রথম চর এলাকায় সামান্য জমিতে ভুট্টার আবাদ করেন। ফলন ভালো হওয়ায় পরের বছর প্রায় দুই বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেন। এরপর থেকেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো চর এলাকায় ভুট্টার আবাদ।
আরও পড়ুন: ফরিদপুর / ব্যয়ের চেয়ে বাজারদর কম, পেঁয়াজ চাষিদের মুখে মলিন হাসি!
রুবেল মিয়া জানান, তার প্রতিবিঘা জমিতে ভুট্টাচাষে সবমিলে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। যা থেকে গড়ে প্রতি বিঘায় ৬০ মণ ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে। বর্তমানে বাজারে প্রতিমণ ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে ১১শ’ থেকে ১২শ’ টাকা। সেই হিসেবে তার প্রতিবিঘা থেকে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
তবে সার ও কীটনাশকের দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, প্রতিবিঘা ভুট্টা চাষে ২ বস্তা ডিএবি, ইউরিয়া, জিপসাম, ১ বস্তা পটাশ ও অন্যান্য ওষুধ লেগেছে। তাতে প্রায় ১৫ হাজার টাকা লেগেছে। এরমধ্যে দুই বস্তা ইউরিয়া ও ডিএবি সার প্রায় ৬ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন। এছাড়া সেচ ও শ্রমিক খরচে আরও ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সরকার যদি সার ও কীটনাশকের দাম কমিয়ে দিত তাহলে আমাদের জন্য উপকার হতো।
ক্ষুদ্র চাষি হিসেবে তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন ভুইয়াডাঙ্গী গ্রামের আফতাব মোল্যা। এসব জমি থেকে প্রায় ১ লাখ টাকা আয় হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আগে এই চরে বাদাম চাষ অইতো। কিন্তু তাতে আমাগো কোনো লাভ অইতো না। এখন চক্কের চক (মাঠ) শুধু ভুট্টার ক্ষেত। এবছর ভালো ফলনও অইছে।’
তবে এসব ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের আক্ষেপও রয়েছে। তাদের অধিকাংশ অপরের জমি বর্গা বা মৌসুমিভিত্তিক চুক্তিতে চাষাবাদ করে থাকেন। তাতে উৎপাদন খরচের পাশাপাশি আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেশি খরচ হয়ে থাকে।
চাষি সেকেন মোল্যা বলেন, ‘ধারদেনা ও সুদের ওপর টাকা এনে ভুট্টার চাষ করছি। বিক্রি করার পর দেনা শোধ করার পর অল্প কিছু টাকা হাতে থাকে। তা দিয়েই সারা বছরের কোনো রকমে সংসার চলে। সরকার যদি সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে লাভবান হতে পারতাম। চরাঞ্চলে ভুট্টার আবাদ আরও বাড়তো।’
ভুট্টা চাষি রাশেদ শেখ বলেন, ‘এক সময় ধু ধু বালুচরে কোনো চাষাবাদ হতো না। প্রথমে বাদাম চাষ করা হতো তাও ফলন ভালো হতো না। এখন চরের সবাই ভুট্টার আবাদ করছে। উচ্চ ফলনশীল ভুট্টা আবাদ করে ফলনও ভালো হয়েছে।’
আরও পড়ুন: লালমিতে হাসছে ফরিদপুরের কৃষক, ৪৫ কোটি বাণিজ্যের টার্গেট!
তিনি আরও জানান, চরাঞ্চলের সবাই ভুট্টা আবাদের আরো একটি কারণ রয়েছে। চরে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারেই গরু পালন করে থাকে। অন্যতম আয়ের উৎস গরু পালন। ভুট্টার কাঁচা পাতা গরুকে খাওয়ানো হয়। এতে করে গরু পালনে খাবার খরচ কমে যায়। আর ভুট্টা বিক্রি করেও লাভ হয়। এ কারণে চরাঞ্চলের বাসিন্দারা ভুট্টা আবাদে ঝুঁকছে সবাই।
ক্ষেত থেকে ভুট্টা তোলার কাজ করছেন নারগিছ বেগম। তিনি জানান, এই সময়ে আমরা ভুট্টা তোলা, মাড়াইয়ের কাজ করে থাকি। প্রতিদিন ৫৫০টাকা মজুরি পাই। এদিয়েই সংসার চলে যায়। এছাড়া বছরের অন্য সময় বাদাম ও কলাই তোলার কাজ করে থাকি।
স্বামীর সাথে ভুট্টা রোদে শুকানোর কাজ করছেন আসমা আক্তার। তিনি বলেন, চরাঞ্চলে পরিবারের সবাইকে কাজ করতে হয়, তা না হলে শ্রমিকের মজুরি দিতেই সব টাকা চলে যাবে। এ কারণে এই সময় স্বামীর সঙ্গে নিজে কাজ করি, সন্তানরাও কাজ করে থাকে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৫ হাজার ৮৭১ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬১ হাজার ৬৪৫ মেট্রিক টন। বর্তমানে প্রতি মণ ভুট্টা ১ হাজার ১শ’ টাকা থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা বিক্রি হচ্ছে। সে হিসেবে প্রায় ২শ’ কোটি টাকার বানিজ্য হবে। তবে এর সিংহভাগ উৎপাদন হয়েছে জেলার বিভিন্ন উপজেলার চরাঞ্চলে।
ফরিদপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন জানান, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে শুধু সদর উপজেলাতে ২ হাজার ৩শ’ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। যার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ চর এলাকাতেই। এছাড়া প্রতিবছর ভুট্টার চাষ ব্যাপক হারে বাড়ছে বলে তিনি জানান।
ফরিদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহাদুজ্জামান জানান, চলতি বছর ভুট্টা লক্ষ্যমাত্রার অধিক আবাদ হয়েছে। জেলায় বিগত দিনের তুলনায় ভুট্টার আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছর ৫ হাজার ৮শ ৭১ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার হেক্টর থেকে কর্তন করা হয়েছে। উৎপাদন যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল আশা করছি, তা ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি আরও জানান, উচ্চ ফলনশীল ভুট্টা আবাদে বাম্পার ফলন হয়েছে, পাশাপাশি দামও ভালো পাওয়ায় চাষীরা খুশি। তবে ভুট্টা আবাদের লাভের আরেক দিক হলো ভুট্টার পাতা গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চরাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারই গরু পালন করে থাকে। গরুর খাবারও হচ্ছে, ভুট্টাও বিক্রি করে লাভ হচ্ছে। একারণে চরাঞ্চলের চাষিরা ভুট্টা আবাদে বেশি ঝুঁকছেন। চলতি বছর ১৮৫ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আশা করছি।