হাসপাতালের প্রধান সহকারী আশরাফুন নিসা আশা বলেন, ‘চিকিৎসকদের থাকার স্থানে আমরা অফিস কক্ষ বানিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের রুমগুলো কার্যক্রম চালানোর জন্য অত্যন্ত ছোট। গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রাখার জন্য নেই কোন ভাল ব্যবস্থা। একটি মাত্র টেবিলের ওপরে ফাইল রাখতে হয় ছড়িয়ে ছড়িয়ে। অফিস কক্ষে কেউ আসলে বসতেও দেয়া যায় না। ভাঙাচুরা পুরাতন কক্ষের রং পলেস্তারা উঠে যাচ্ছে। এভাবে কাজ করা আমাদের জন্য নয় শুধু, সেবা প্রত্যাশীদের জন্যেও অনেক কষ্টসাধ্য।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের একটি ঘরের মধ্যে অনেকগুলো অফিস কক্ষ থাকার কারণে ছোট ছোট রুমগুলোতে অফিস কার্যক্রম সুন্দরভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। বেশ কয়েক মাস আগেই আমাদের নড়িয়া ৫০ শয্যা বিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতালের কাজ শেষ হয়েছে। সে হাসপাতালটিতে সব ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ অফিস কক্ষগুলো বেশ প্রশস্ত। সেখানে যেয়ে কাজ করতে পারলে সেবা প্রত্যাশীদের সঠিক ও সুন্দরভাবে সেবা দেয়া সম্ভব হতো। সকল জটিলতা কাটিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আধুনিক মানের এই হাসপাতাল থেকে কার্যক্রম স্থানান্তর করার জন্য অনুরোধ করছি।
হাসপাতালে ভর্তি চিকিৎসা নিতে আসা আলফাতুন্নেসা বলেন, ‘আমরা যেই কক্ষে ভর্তি আছি সেই কক্ষটি অত্যন্ত পুরাতন। কক্ষটির অবস্থা খুবই খারাপ। দেয়াল ছাদের ভিম খুঁটিসহ বিভিন্ন স্থানে ফাটল রয়েছে। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি ভবন। এখানে চিকিৎসা নিতে ও দিতে উভয়ই ঝুঁকি রয়েছে। আমরা যেমন বাধ্য হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি, অন্যদিকে ডাক্তাররাও ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছে। আমাদের একটি আধুনিক মানের হাসপাতাল নির্মাণ হয়েছে। কেন কি কারণে হাসপাতালটি চালু হচ্ছে না আমার জানা নাই। তবে কোন জটিলতা থাকলে সে জটিলতা কাটিয়ে আধুনিক মনের হাসপাতালটি চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করতে পারলে যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যেত। কিছু অতি উৎসাহী মানুষের জন্য আজকে আমরা আধুনিক ও সুন্দর পরিবেশে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
নড়িয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি আব্দুল খালেক পেদা ইমন বলেন, ‘২০১৭-১৮ সালে পদ্মা নদী ভাঙনের কারণে মুলফৎগঞ্জ হাসপাতালটির মূল ভবন পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। কোন উপায়ান্তর না পেয়ে ওই হাসপাতালের অন্যান্য পরিত্যক্ত ভবনগুলোতে চিকিৎসা সেবা চালু রাখেন কর্তৃপক্ষ। এরপরে নড়িয়া উপজেলার ১৪ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষের জন্য নড়িয়া পৌরসভার বৈশাখী পাড়া এলাকায় আধুনিক মানের হাসপাতাল করার কর্মপরিকল্পনা নেন।’
আরও পড়ুন: বাঁশ ও গাছের গুঁড়ি দিয়ে হাসপাতাল ভবনের ফাটল ঠেকানোর চেষ্টা
তিনি বলেন, ‘গত ছয় মাস হলো হাসপাতালটির কার্যক্রম শেষ হয়েছে। চিকিৎসা সেবা দিতে হাসপাতালটির সব ধরনের কার্যক্রম এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অথচ পুরাতন হাসপাতাল সরিয়ে না নিতে স্থানীয়দের একটি মামলার কারণে নতুন এই আধুনিক হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে পারছে না। এতে আধুনিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার মানুষ। এই হাসপাতালটিতে উন্নত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা থাকলেও তা করতে না পারায় বাধ্য হয়ে রোগীরা ছুটছেন জেলা সদরসহ ঢাকায়। এতে রোগীরা যেমন ঝুঁকিতে পড়ছে তেমনি ব্যয়ভার বাড়ছে অনেক।’
তিনি আরও বলেন, ‘আধুনিক মানের এই হাসপাতালটি নড়িয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে। পুরো উপজেলার সকল মানুষেরই নড়িয়া সদরে আসতে হয়। অত্যন্ত চমৎকার একটি পরিবেশে হাসপাতালটি নির্মিত হয়েছে। উপজেলার সকল মানুষের জন্য এই হাসপাতালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালটি চালু করা হোক।’
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার কামরুল জমাদ্দার বলেন, ‘২০১৮ সালে আমাদের হাসপাতালের তিনতলা বিশিষ্ট মূল ভবন পদ্মা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকেই হাসপাতালের সকল কার্যক্রম চলছে বিভিন্ন কোয়ার্টার বা বাসভবনের রুমগুলোতে। হাসপাতালের একটি পরিত্যক্ত ভবনে চলছে ইনডোর চিকিৎসা সেবা। আমাদের ৫০ শয্যা হাসপাতাল হলেও একটি জরাজীর্ণ ভবনে আমরা চিকিৎসা দিতে পারছি মাত্র ২০ থেকে ২৫ জনের। এক্সরে মেশিন থাকা সত্ত্বেও কক্ষের অভাবে মেশিনটি বসিয়ে সেবা দিতে পারছি না। আমাদের প্যাথলজি ডিপার্টমেন্ট স্বল্পপরিসরে চালাতে হচ্ছে। অপারেশন থিয়েটারের কাজও চলছে কোয়ার্টারের একটি ছোট্ট কক্ষের মধ্যে স্বল্পপরিসরে। অথচ নড়িয়া শহরে অত্যন্ত আধুনিক মনের একটি হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। সেখানে একটি চমৎকার চারতালা ভবন রয়েছে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক, নার্স, অফিস সহকারীসহ তাদের থাকার জন্য রয়েছে আধুনিক মানের ভবন। হাসপাতালটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্যেও ঠিকাদার সময় নির্ধারণ করেছেন। অথচ আমাদের এই পুরাতন হাসপাতালটির পাশের কিছু মানুষ মূল ক্যাম্পাস হিসেবে পুরাতন হাসপাতালটিকেই রাখতে চায় মর্মে, পুরাতন হাসপাতাল থেকে ডাক্তার নার্স বা কোন মালামাল নেয়া যাবে না মর্মে হাইকোর্টে একটি রিট করে। এই রিট করার জন্য আমরা আধুনিক নতুন হাসপাতালে যেতে পারছি না। ফলে ৫০ শয্যা হাসপাতালে যে ধরনের কার্যক্রম বা স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার কথা তা আমরা দিতে পারছি না।’
আরও পড়ুন: এক চিকিৎসক দিয়ে চলছে খুলনায় ৫০ বছরের পুরনো হাসপাতালটি
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নতুন হাসপাতালটি হ্যান্ড ওভার নিতে চাই। কার্যক্রমের জন্য নতুন হাসপাতালটিতে যেতে চাই। নতুন হাসপাতালটিতে গেলে নড়িয়া উপজেলার সকল মানুষের জন্য আধুনিক ও চমৎকার পরিবেশে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া সম্ভব হবে। এতে এক দিকে যেমন সেবা গ্রহী তারা চমৎকার পরিবেশে সেবা পেতে পারবে অন্যদিকে আমরাও যথাযথভাবে চিকিৎসা সেবা দিতে পারব।
এ বিষয়ে শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন আবুল হাদী মো, শাহপরান বলেন, মুলফৎগঞ্জ হাসপাতালটি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পরে চিকিৎসকরা অত্যন্ত কষ্ট করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন পরিত্যক্ত কোয়াটার ও জরাজীর্ণ ঘরে স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিঘ্নিত হচ্ছে। বিভিন্ন সেবাগুলো আমরা সীমিত আকারে দিতে পারছি। আমাদের জায়গা যদি আরও বড় হতো তাহলে আমরা চিকিৎসা সেবা আরও ভালোভাবে দিতে পারতাম। জরাজীর্ণ এই হাসপাতালটিতে পুরোপুরি সেবা দিতে আমরা ব্যর্থ। (মামলা জটিলতার কারণে নতুন হাসপাতালে স্থানান্তর বিষয়ে কোন কথা বলতে নারাজ সিভিল সার্জন)।’
১৪ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষের বসবাস। তাদের চিকিৎসা সেবা সুন্দরভাবে দেয়ার চিন্তা করে একটি আধুনিক মানের হাসপাতাল নির্মিত হলেও মামলা জটিলতায় এটি চালু হচ্ছে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলা জটিলতা কাটিয়ে আধুনিক এই হাসপাতালটি চালু করার দাবি স্থানীয়দের।