বর্তমান সময়ে ওয়াজ-মাহফিল আর সেই নবীযুগের সরল-সাবলীল ধারায় নেই। বিশেষত বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিল এখন শুধুই একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; বরং এটি রেওয়াজ ও সামাজিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। নব্বই দশকের পর থেকে এটি জাঁকজমকপূর্ণ একটি রূপ নিয়েছে।
আগের সাদামাটা আয়োজনের জায়গায় এসেছে আলোকসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেম, বিপুল খরচের আয়োজন। একদিকে বক্তারা তাদের কণ্ঠে যুক্ত করেছেন রসবোধ ও আধুনিক যুক্তি, অন্যদিকে এ মাহফিল থেকে যদি কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ দেয়া যায়, তাহলে এ মাহফিলগুলো হয়ে ওঠবে দীন প্রচারের সর্বোত্তম মাধ্যম। তারপরও এ মাহফিলগুলোর কারণে সমাজে অনেক সুফল তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: কম্বোডিয়ায় যেভাবে ইসলামের সূচনা হয়
১. অসৎ সংস্কৃতি প্রতিরোধ: ওয়াজ-মাহফিলের একটি বড় সুফল হলো, এটি সমাজ থেকে অশ্লীলতা ও অসৎ সংস্কৃতি অনেকাংশে কমিয়ে এনেছে। আগে যেখানে যাত্রাপালা, বাউল গান, নাটকের মতো আয়োজন ছিল জনসমাগমের কেন্দ্র, এখন সেসব অনেকটাই কমেছে।
২. ধর্মীয় শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: ওয়াজ-মাহফিল এখনও বহু মানুষের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়। এটি মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি এবং পরকালের চিন্তা সৃষ্টি করতে পারে।
৩. সামাজিক সংযোগ ও মূল্যবোধ জাগরণ: ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি পায়। এগুলো মানুষকে নৈতিকতা, সৎকর্ম, মানবিক দায়িত্বের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে।
আবার এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো অবশ্যই বর্জনীয়
১. অপ্রয়োজনীয় খরচ: বর্তমান সময়ে ওয়াজ-মাহফিল আয়োজনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, তা প্রায়শই অপচয়ের শামিল। সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিং, বক্তাদের মোটা ভাতা এ খরচের বড় অংশ। এগুলো কমিয়ে আনতে পারলে এ মাহফিলগুলো নবীযুগের মাহফিলের মতই মানুষের হেদায়েতের আলোবর্তিকা হয়ে ওঠবে।
২. অসংযত আয়োজন: গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ শব্দে অনুষ্ঠান চালানো অসুস্থ মানুষ, শিশু, বৃদ্ধদের কষ্ট দেয়। ৩. বক্তা ও আয়োজকদের নিয়ত: অনেক ক্ষেত্রে বক্তা ও আয়োজকদের মধ্যে আত্মপ্রচার ও আর্থিক লাভের প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা ওয়াজ-মাহফিলের মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
৪. মেলা ও অপ্রাসঙ্গিক কার্যকলাপ: অনেক ওয়াজ-মাহফিলের সাথে মেলার আয়োজন হয়, যা ধর্মীয় পরিবেশকে নষ্ট করে, নারীদের অনৈতিক সমাগমের মতো সমস্যার সৃষ্টি করে।
নবীযুগের মাহফিল ছিল সাদামাটা, আন্তরিক আর গভীর শিক্ষায় পরিপূর্ণ। সেখানে কেবল আল্লাহভীতি জাগ্রত করা হতো, মানুষকে সৎপথে চলার দীক্ষা দেওয়া হতো। বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে বিনয়, আন্তরিকতা এবং ইখলাস ছিল। বর্তমান সময়েও যদি সেই ধারাকে পুনর্জীবিত করা যায়, তবে ওয়াজ-মাহফিলের প্রকৃত ফায়দা সমাজে আসতে পারে।
আরও পড়ুন: কম্বোডিয়ায় যেভাবে ইসলামের সূচনা হয়
ওয়াজ-মাহফিল আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি রোধ করা উচিত নয়। তবে এর প্রাসঙ্গিক সংস্কার প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় খরচ ও অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়ে যদি মাহফিলগুলো মসজিদকেন্দ্রিক হয়। রাত ১১টার মধ্যে শেষ করা যায়, তবে এটি সমাজের জন্য আরও উপকারী হবে।
ব্যক্তি বা অর্থনৈতিক ফায়দার চেয়ে এর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের আত্মিক উন্নয়ন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। যথাযথ পরিকল্পনা ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ওয়াজ-মাহফিলকে নবীযুগের সাদামাটা ও আন্তরিক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
]]>